দোলাচলে ভারতের রফতানি ক্ষেত্র। ছবি- এএফপি।
এ বার বাজেট এমন একটা সময় হচ্ছে যখন দেশের অর্থনীতি এক ভয়ানক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি অর্থবর্ষে ভারতের বৃদ্ধি হবে ৪.৮ শতাংশ যা অক্টোবরের পূর্বাভাস অনুযায়ী ছিল ৬.১ শতাংশ। চলতি আর্থিক বছরের এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে শিল্পোৎপাদন সূচক বৃদ্ধির গড় হার দাঁড়িয়েছে ০.৬ শতাংশ। ২০১৮-১৯ আর্থিকে বছরের এই সময়ে যা ছিল ৫ শতাংশ।
এরই মধ্যে বৃদ্ধির রেকর্ড গড়ল মুদ্রাস্ফীতি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে খুচরো মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৩৫ শতাংশ। নভেম্বরে যা ছিল ৫.৫৪ শতাংশ। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে শেষ বার মুদ্রাস্ফীতির হার এতটা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
রফতানির ক্ষেত্রের অবস্থাও খুবই শোচনীয়। ডিসেম্বরে দেশের রফতানি ১.৮ শতাংশ কমে হল ২৭.৩৬ বিলিয়ন (২৭৩৬ কোটি) মার্কিন ডলার। এ নিয়ে টানা ৫ মাস সরাসরি কমলো রফতানি। রফতানিকারকদের মতে— আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং চাহিদার ঘাটতি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-র মতে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পণ্য কেনাবেচার ব্যবসা এ বছর বড়জোর ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। এপ্রিলে যেখানে ব্যবসা বৃদ্ধির পূর্বাভাস ছিল ২.৬ শতাংশ।
গত বাজেটে অর্থমন্ত্রী ভারতকে পাঁচ ট্রিলিয়ন (পাঁচ লক্ষ কোটি) মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে উত্তীর্ণ করবার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আর যে লক্ষ্য পূরণে অন্যতম ভূমিকা পালন করতে হবে রফতানি ক্ষেত্রকে। অর্থনীতি পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার হওয়ার জন্য রফতানি ক্ষেত্রের আগামী পাঁচ বছরে পরিমাপ হতে হবে ন্যূনতম এক ট্রিলিয়ন (এক লক্ষ কোটি) মার্কিন ডলার। কিন্তূ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অস্তিরতা এবং চাহিদার অভাবের কারণে ভারতে রফতানি ক্ষেত্র বর্তমানে দোলাচলের মধ্যে রয়েছে।
এই মুহূর্তে দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যাবস্থার হাল ও একেবারেই আশাপ্রদ নয়। সরকারের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালের জুন মাসের শেষে ভারতের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির মোট অনুৎপাদিত সম্পদের পরিমাণ ৯.৩৮ লক্ষ কোটি টাকা, অর্থনীতির পক্ষে যা রীতিমত বিপজ্জনক। যদিও অর্থমন্ত্রী শ্রীমতি নির্মলা সীতারামন সাম্প্রতিককালে ব্যাঙ্কিং ব্যাবস্থার উন্নতির জন্য কিছু পদক্ষেপ করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সরকারি মালিকানাধীন ব্যাঙ্কগুলোতে ৭০,০০০ কোটি টাকার জোগান দেওয়া। কিন্তূ তার ফলাফল খুব আশাপ্রদ কিছু হয়নি। এমতাবস্থায় ব্যাঙ্কিং ব্যাবস্থাকে চাঙ্গা করাই ভারতকে পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনীতিতে উত্তীর্ণ করার ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে। বাজারে ঋণের চাহিদা বাড়ানোর জন্য অর্থমন্ত্রী আগামী বাজেটে কী কী পদক্ষেপ নেন তার জন্যও অপেক্ষায় থাকবেন শিল্পপতিরা।
আরও পড়ুন: অর্থনীতি দিশাহীন, বাজারে আঁচ, সব ভুলেই চলছে নাগরিকত্ব ‘যুদ্ধ’
কিছু দিন আগে রফতানিতে ভর্তুকি দেওয়া নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-তে নালিশ জানিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। তাদের মতে এ ধরনের ভর্তুকি অনৈতিক সুবিধা দিয়ে প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করে। এ হেন অবস্থায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে রফতানিতে প্রদান করা ভারতের ভর্তুকিগুলির ভবিষ্যত্। ফলে রফতানিকারকদের অনিশ্চয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার ইতিমধ্যেই বিকল্প হিসেবে 'RoDTEP বা রেমিশন অফ ডিউটিস অর ট্যাক্সেস অন এক্সপোর্ট প্রোডাক্ট' প্রকল্পের ঘোষণা করেছে। এই প্রকল্পের রূপায়ণের ক্ষেত্রে সরকার কী নীতি গ্রহণ করে তার অপেক্ষায় থাকবে দেশের রফতানিকারকরা।
আরও পড়ুন: কাজ থেকে ক্রয়ক্ষমতা, ব্যাঙ্ক থেকে বৃদ্ধি, সর্বত্রই গভীর সঙ্কটের ছবি
জিএসটি শুরু হওয়ার পর থেকেই রফতানিকারকরা রিফান্ড সংক্রান্ত পদ্ধতিগত জটিলতার সমস্যায় জর্জরিত। যার সম্পূর্ণ নিরসন এখনও হয়নি। তাই এই সমস্যাগুলি সমাধানের ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগের দিকেও নজর থাকবে।
রফতানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি বা এফটিএ (Free Trade Agreement)। কিন্তূ অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে যে, এই এফটিএ-গুলি রফতানির থেকে আমদানিকে বেশি উৎসাহিত করেছে। ফলস্বরূপ বৃদ্ধি পেয়েছে বাণিজ্য ঘাটতি। তাই ভবিষ্যতে এফটিএ প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারের অভিমুখ কী হয় তার দিকেও নজর থাকবে রফতানিকারকদের।
(লেখক রফতানি বাণিজ্য বিশ্লেষক)
গ্রাফিক: সৌভিক দেবনাথ