বিষ্ণুবাহন গরুড়ের অমৃতকলস এই মর্তভূমে হরিদ্বার, প্রয়াগ, উজ্জয়িনী ও নাসিকের চারি নগরীতে কী ভাবে, কতখানি উপচাইয়া পড়িয়াছিল, কেহ দেখে নাই। দেখিতে হইবেই বা কেন? বিশ্ব-ঐতিহ্য সর্বদা আগরার তাজমহল, মিশরের পিরামিড বা চিনের প্রাচীরের ন্যায় চর্মচক্ষে দ্রষ্টব্য নহে। ইন্দোনেশিয়ায় যে ভাবে কাপড়ের উপর বাঁশের সুচে গলানো মোম দিয়া বাটিক ছাপাই হয়, মঙ্গোলিয়ায় উটপালকেরা যে ভাবে মৃদু সুরে বাদ্যযন্ত্র বাজাইয়া মা উটকে অনাথ উটশাবক গ্রহণে বাধ্য করেন, তাহাও ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব-ঐতিহ্য।
এ দেশের পুরাণকারেরা এই সত্য অবগত ছিলেন, তাই ঐতিহ্য বলিতে কেবল সৌধ বা অট্টালিকা ভাবিতেন না, জানিতেন— যাহা কিছু পরম্পরা তাহাই ঐতিহ্য। ইউনেস্কো কুম্ভমেলাকে বিশ্ব-ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়া সেই সত্য ফের স্মরণে আনিলেন।
সত্য আরও অনেক। কুম্ভযোগ বা কুম্ভরাশি নহে, চারি শহরে মাসাধিক কালব্যাপী অস্থায়ী তাঁবুনগরীর কুম্ভমেলাটিই ঐতিহ্য। মেলার মুকুটে এত দিন বিশ্বের বৃহত্তম মেলা, সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব— অনেক পালকই ছিল। কিন্তু বৃহত্ত্বের তকমা কখনওই জানায় না, প্রয়াগকুম্ভে স্নানের শেষে কেন লক্ষ লক্ষ মানুষ বালুচরে আকবরের দুর্গে প্রবেশ করিয়া অক্ষয়বটে প্রণত হন। উপকথা: বাবরের পৌত্র বিগত জন্মে প্রয়াগে হিন্দু সন্ন্যাসী ছিলেন। ‘সর্ববৃহৎ’ বিশেষণটি জানায় না, কেন শৈব দশনামী ও বৈষ্ণব তথা বৈরাগী নাগা যাবতীয় ধর্মযুদ্ধ সত্ত্বেও একই মাহেন্দ্রক্ষণে নদীতে স্নান করিবেন, এবং তাঁহাদের পাশাপাশি কাপালিক, তান্ত্রিক হইতে দরবেশ, ফকির, শিখ সন্ন্যাসী হইতে নিম্নবর্গের কবীরপন্থী, সন্ত রুইদাসপন্থী সকলেই তাঁবু গাড়িবেন। মিডিয়া-খেতাব জানায় না, ত্রিশূলধারী, ভস্মাচ্ছাদিত নাগা সন্ন্যাসী কেন বাদশাহের সম্মান পাইবেন, তাঁহাদের স্নানপর্বটির নামই হইবে শাহি স্নান! ঐতিহ্য শব্দটিতে সেই প্রবহমান বহুত্বের ইঙ্গিত রহিয়াছে।
কুম্ভমেলা চলমান সংস্কৃতির ধারক। টিভি, পত্রপত্রিকার কল্যাণে কুম্ভমেলা আজ অবিরত মহাদৃশ্য। নাগা সাধু মোবাইলে কথা বলিতেছেন, ক্যামেরার ঝিলিক! সন্ন্যাসী ত্রিশূল হাতে বাইকে চাপিয়াছেন, মিডিয়া হামলাইয়া পড়িল। নূতন দৃশ্যের জন্ম, অবশ্যই! কিন্তু আত্মাটি পুরাতন। ভারতীয় ঐতিহ্যে সাধু নিছক বিবিক্ত, গুহাবাসী নহেন। গৃহীসমাজ ও সাধুসমাজ এই দেশে জনসমাজের অঙ্গ, যাজ্ঞবল্ক্য তাই রাজা জনকের রাজসভায় আসেন। অষ্টাদশ শতকের কুম্ভমেলায় সাধুরা হাতি, ঘোড়া, উট ও বহু মূল্য রত্নের সম্ভার সাজাইয়া বসিতেন। রাজা-মহারাজারা আসিতেন। এখন রাজা নাই, সেই সাধুসম্ভারও নাই। কিন্তু লক্ষাধিক মানুষের ভিড়ে গৃহী-সাধু আদানপ্রদান অমর। গঞ্জিকার ধূম্রজালে আচ্ছন্ন সেই পরিসরে একটি গণতান্ত্রিক চেতনাও নিহিত। নাগা সাধুদের ‘শ্রীপঞ্চায়েতি আখড়া’গুলির কর্মাধ্যক্ষরা এই কুম্ভমেলাতেই সাধুদের ভোটে নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনপর্ব সমাধা হয় এই কুম্ভস্নানেই। আখড়ার কোন বড় সাধু বা মণ্ডলেশ্বর পদোন্নতি পাইয়া আরও বড় সাধু তথা মহামণ্ডলেশ্বর হইবেন, তাহাও স্থির হয় এই মেলায়। কুম্ভ তাই শুধু মেলা নহে। থাকবন্দি সমাজ, গণতান্ত্রিক চেতনা, ভিন্নমতের আদানপ্রদান সব মিলিয়া জীবন্ত এক ভারততীর্থ। ইউনেস্কো ইহাকেই স্বীকৃতি দিয়াছে।