প্রবন্ধ ২

ওজন বাড়ছে গরিবেরও

টিফিনে দু’মিনিটের নুডলস। স্কুল ছুটি হলে পিৎজা-রোল-বিরিয়ানি। শহর-মফস্সল সর্বত্র কচিকাঁচাদের পছন্দের খাবার তাদের ওজন বাড়াচ্ছে, অথচ খামতি রেখে দিচ্ছে পুষ্টিতে।

Advertisement

সুমিত মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৭ ০০:৪৪
Share:

টিফিনে দু’মিনিটের নুডলস। স্কুল ছুটি হলে পিৎজা-রোল-বিরিয়ানি। শহর-মফস্সল সর্বত্র কচিকাঁচাদের পছন্দের খাবার তাদের ওজন বাড়াচ্ছে, অথচ খামতি রেখে দিচ্ছে পুষ্টিতে। গত বছর প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক রিপোর্ট বলছে, প্রতি পাঁচ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে দু’জন অতিরিক্ত ওজন (ওভারওয়েট), বা স্থূলতায় (ওবিসিটি) ভুগছেন। এতে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের অসুখ প্রভৃতি দীর্ঘমেয়াদি অসুখের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বিশেষত শৈশব-কৈশোরে স্থূলত্ব জনস্বাস্থ্য-সংকটের অশনিসংকেত। ভারতে বেশ কয়েকটি রাজ্যে জেলা স্তরের সমীক্ষা (২০১২-১৩) থেকে দেখা যাচ্ছে যে পাঁচ থেকে আঠারো বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রায় ২৪ শতাংশ ছেলে এবং ২০ শতাংশ মেয়ের ওজন বেশি। এদের পাঁচ থেকে সাত শতাংশ স্থূল বা ‘ওবিস’। এ রাজ্যে এদের ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত ওজনে ভারাক্রান্ত। এই প্রবণতা বজায় থাকলে অচিরে গ্রামের গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও স্থূলতা দেখা দেবে। তা থেকে এমন রোগ জন্ম নেবে যার চিকিৎসা খরচসাপেক্ষ।

Advertisement

জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় (এনএসএসও) বিভিন্ন খাদ্যবস্তুর জন্য পরিবারগুলি কতটা ব্যয় করে, তার হিসেব নেওয়া হয়। সাম্প্রতিক রিপোর্ট দেখাচ্ছে যে, প্যাকেটের খাবার বা ভাজাভুজি খাওয়ার পরিমাণে গরিব-বিত্তবানে খুব বেশি তফাত নেই। কিন্তু যে পরিবারের রোজগার যত বেশি, তারা তত বেশি তাজা ফল বা শাকসবজি খাচ্ছে। অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার হারে ধনী-দরিদ্রে তেমন তফাত নেই। পার্থক্য প্রকট হচ্ছে পুষ্টিকর খাবারের বেলায়।

মনে হতে পারে, যার যেমন স্বাদ পছন্দ সে তেমনই খাচ্ছে, এতে আর বলার কী আছে? কিন্তু তা হলে পরিবারের আয়ের সঙ্গে খাবারের পছন্দ-অপছন্দ বদলে যাচ্ছে কী করে? তার কোনও তত্ত্ব বা পরিসংখ্যান থেকে কোনও ব্যাখ্যা মিলছে না। পুষ্টির অর্থনীতি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন সেই গবেষকদের মতে খাবারের ‘পছন্দ’কে যা নিয়ন্ত্রণ করে তা হল খাদ্যবস্তুর দাম এবং পরিবারের ঘরোয়া বাজেটের মধ্যেকার সম্পর্ক। গরিব বা স্বল্পবিত্ত পরিবারগুলির আয় যত তাড়াতাড়ি বাড়ছে, তার চাইতে দ্রুত হারে বাড়ছে তাজা ফল বা শাকসবজির দাম। ফলে ওই সব খাবার আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। তখন তাদের খাদ্যের চাহিদা সস্তা, অপুষ্টিকর, মুখরোচক খাবার দিয়েই মেটাতে হচ্ছে।

Advertisement

২০০৯ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশিত নানা ধরনের খাদ্যবস্তুর পাইকারি এবং খুচরো বাজারদরের ওঠাপড়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিগত প্রায় দশ বছরে, যেখানে খাদ্যদ্রব্যের গড় খুচরো মূল্যসূচক বেড়েছে বাৎসরিক ৮.৭ শতাংশ হারে, সেখানে ফল এবং শাকসবজির মূল্যসূচক বেড়েছে ৯.৩ শতাংশ হারে। আজ এক কিলোগ্রাম ওল বা সজনে ডাঁটার যা দাম (৬০ টাকা) তাতে খোলা বাজার থেকে অন্তত তিন কিলোগ্রাম আলু, বা আড়াই কিলোগ্রাম চাল কেনা যায়। ফল ও শাকসবজির এই ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখী দাম কিন্তু কৃষি-অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনে হয়নি। এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করায় কৃত্রিম ভাবে দাম বাড়ছে। ফলে এক দিকে ছোট চাষি উপযুক্ত লাভের মুখ দেখেন না, অন্য দিকে গরিব পরিবার দেশি ফলও কিনতে পারে না। সেই সঙ্গে, সংরক্ষণের অভাবে এ দেশে ফল ও শাকসবজির একটা বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। তাতেও দাম বেড়ে যায় অবশিষ্ট উৎপাদনের। অগত্যা বাজারচলতি সস্তা খাবার কিনছে পরিবার। তাতেই অভ্যস্ত হচ্ছে শিশুরা। সেই সঙ্গে, শরীরচর্চা-খেলাধুলো-দৌড়ঝাঁপ কমছে। বাড়ছে ওজন।

অপুষ্টি যেমন মারাত্মক, অধিক ওজনজনিত অপপুষ্টিও তেমনই ক্ষতিকর। ভারতে একই সঙ্গে অপুষ্টি আর অপপুষ্টির জনস্বাস্থ্যে সংকট তৈরি করতে চলেছে। শুকনো উপদেশ দিয়ে লাভ নেই। বেশি চিনি, ফ্যাটযুক্ত খাবারের ওপর কর বসিয়ে চাহিদা কমানোর চেষ্টা করতে হবে। একই সঙ্গে পুষ্টিকর খাবার সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে আনার উদ্যোগ চাই। চাষি এবং ক্রেতা, উভয়ের স্বার্থরক্ষা প্রয়োজন।

ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ, কল্যাণী-র শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement