—ফাইল চিত্র।
চক দে! ইন্ডিয়া’-র কবীর খানকে মনে আছে? ভারতীয় মহিলা হকি টিমের নতুন কোচের সঙ্গে খেলোয়াড়দের প্রথম মোলাকাত। এক এক জন নিজের নাম বলছে, সঙ্গে নিজের রাজ্যের নাম। কবীরের ভূমিকায় শাহরুখ খান চোয়াল শক্ত করে বলছেন, ‘আউট’। টিমের বাইরে গিয়ে দাঁড়াও।
কবীর খান ভারতীয় টিমে এমনই খেলোয়াড় চেয়েছিলেন, যারা শুধু ‘ইন্ডিয়া’-র হয়ে খেলবে। খেলোয়াড়দের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকতেই পারে। কিন্তু দিনের শেষে সবাইকে ‘টিম ইন্ডিয়া’-র জন্যই খেলতে হবে। একে অন্যকে সাহায্য করতে হবে।
নরেন্দ্র মোদী অনেকটা কবীর খানের স্টাইলেই শুরু করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম যখন সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন, দেওয়ালে একটা ব্যানার ঝোলানো হয়েছিল। তাতে বড় বড় হরফে লেখা ‘টিম ইন্ডিয়া’।
গোটা দেশ নড়েচড়ে বসেছিল। এত দিন তো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা কেন্দ্রের সরকারের দিকে বঞ্চনার আঙুল তুলেছেন। রাজ্যের অধিকারে কেন্দ্রের নাক গলানোর নালিশ জানিয়েছেন। এই লোকটা তো সে সব আরব সাগরে ফেলে আসতে চাইছেন!
নরেন্দ্র মোদী তার বদলে ‘কম্পিটিটিভ’ ও ‘কোঅপারেটিভ ফেডারালিজ়ম’-এর মন্ত্র দিলেন। রাজ্যগুলি একে অন্যের থেকে ভাল করার প্রতিযোগিতায় নামবে। প্রতিযোগিতা হবে। কিন্তু যার যেটা ভাল, সেটা বাকিরা অনুকরণের চেষ্টা করবে। কেন্দ্র সব রকম সাহায্য করবে। প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতা— দুই মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞা।
ভরসা হয়েছিল। তিনি ১২ বছরের বেশি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। দিল্লির বিজ্ঞান ভবন সাক্ষী, জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে এসে মোদী বার বার মনমোহন সরকারকে সতর্ক করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রদবদলের চেষ্টা করবেন না। মুখ্যমন্ত্রীদের কেন যোজনা কমিশনের সামনে গিয়ে অর্থের জন্য হাত পেতে দাঁড়াতে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের ছ’বছরের মাথায় পরিস্থিতি ঠিক একই মেরুতে। কোভিড অতিমারি সামলানোর টাকা জোগাড়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের যখন নাভিশ্বাস উঠেছে, তখন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি জিএসটি ক্ষতিপূরণের টাকা মেটাতে পারবেন না। এমনিতেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ক্ষোভ ছিল, মোদী সরকার শুধু পরীক্ষা বাড়ানোর, হাসপাতালের শয্যা বাড়ানোর, কোভিড-১৯’এর মোকাবিলার বিভিন্ন পথের নির্দেশই দিয়ে চলেছে। কোথাও গাফিলতি হলেই কেন্দ্রীয় দল পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু এক নয়া পয়সা অর্থ সাহায্য মিলছে না। এমনকি আচমকা দেশ জুড়ে লকডাউন জারি করার আগেও প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেননি বলে অভিযোগ। এ বার জিএসটি ক্ষতিপূরণের টাকা মিলবে না শুনে ক্ষোভের ব্যারোমিটারের পারদ তুঙ্গে উঠেছে।
এমনিতেই জিএসটি চালু হওয়ার পরে পেট্রল-ডিজ়েল, মদের মতো দু’একটি ক্ষেত্র ছাড়া আর কোথাও রাজ্যের কর বসানোর ক্ষমতা নেই। মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় নরেন্দ্র মোদী নিজেই জিএসটি-তে সায় দেননি। প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসলেও নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সমস্যা বুঝবেন, এমনটাই আশা ছিল। কিন্তু তাঁর সরকার প্রতিশ্রুতিমতো টাকা দিতেই নারাজ। কেন্দ্রের সিন্দুকেও টাকা নেই বলে হয়তো মোদী অপারগতার কথা জানাতে পারেন। কিন্তু রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা না করেই একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে চলার পিছনে কোনও অপারগতার যুক্তি খাটে না।
দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফিরতেই মোদী সরকার নয়া নাগরিকত্ব আইন, জাতীয় নাগরিক পঞ্জির দামামা বাজিয়ে দিয়েছিল। রাজ্যকে ছাড়া সিএএ-এনপিআর রূপায়ণ করা যাবে না। অথচ রাজ্যের সঙ্গে কোনও রকম আলোচনাতেই যাননি মোদী-শাহ। ‘টিম ইন্ডিয়া’-র স্লোগানের দফারফা করে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একের পর এক রাজ্যের বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ হয়েছে। মোদী সরকার আয়ুষ্মান ভারতের মতো প্রকল্প চালু করেছে। কিন্তু সিংহভাগ টাকা রাজ্য দিলেও মোদী সরকার তার সব কৃতিত্ব নিয়ে নিতে চাইছে বলেও অভিযোগ।
করোনা আসার পর লকডাউন হল। গোটা দেশ তালাবন্ধ। কিন্তু রাজ্যের সঙ্গে আলোচনায় না গিয়ে মোদী সরকারের একের পর এক পদক্ষেপ বন্ধ হল না। কৃষি ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য অধ্যাদেশ, রাজ্যের আওতা থেকে সমবায় ব্যাঙ্কগুলিকে কেন্দ্রের আওতায় নিয়ে আসার অধ্যাদেশ, শ্রম আইনের সংস্কার, শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের জন্য জাতীয় শিক্ষানীতি, বিদ্যুৎ আইনে সংশোধন—সিদ্ধান্ত আলাদা। অভিযোগ একটাই। রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ। এমনকি রাজ্যগুলি বিদ্যুতের মাশুল বাড়াবে কি না, পুরসভায় জলকর বসাবে কি না, সেখানেও নাক গলানোর চেষ্টা।
তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জয়ললিতা এক বার দিল্লিতে এসে মনমোহন সিংহকে সটান বলেছিলেন, আপনারা তো রাজ্যগুলিকে পুরসভার স্তরে নামিয়ে আনতে চাইছেন। মোদী সরকার কি রাজ্যগুলিকে পুরসভার ক্ষমতাটুকুও দিতে নারাজ? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, রাজ্যের ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে কুক্ষিগত হলে লাভ কী?
না কি এটাই আরএসএস-বিজেপির রাজনৈতিক মতাদর্শ? নরেন্দ্র মোদী অনেক দিন ধরেই ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’-এর কথা বলছেন। তার মূল কথা হল, লোকসভার সঙ্গেই সব রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। নিন্দুকেরা বলেন, মোদী আসলে চান, একই হাওয়ায় কেন্দ্রের সঙ্গে সব রাজ্যেই বিজেপি ক্ষমতায় চলে আসুক। বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীরা নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন, তেমনটা ভাবা মুশকিল। সে ক্ষেত্রে গোটা দেশে বস্তুত তিনিই ছড়ি ঘোরাতে পারবেন।
এর সবটাই বিরোধী বা সমালোচকদের মনগড়া কাহিনি হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া যেত, যদি না আরএসএস-এর দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক এম এস গোলওয়ালকর তাঁর বাঞ্চ অব থটস বইটি লিখে যেতেন। আসলে সঙ্ঘ পরিবার গোড়াতেই আজকের ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে ছিল। সংবিধান তৈরির সলতে পাকানোর সময়েই হিন্দু মহাসভা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বা একাধিক রাজ্য মিলে ভারতের ভাবনার বিরোধিতা করেছিল। তাদের দাবি ছিল, এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা। যেখানে রাষ্ট্রের যাবতীয় ক্ষমতা সংবিধান কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দিয়ে রেখেছে।
বি আর অম্বেডকরের সংবিধান চালু হওয়ার পরেও ১৯৬১-তে গোলওয়ালকর যুক্তি দিয়েছিলেন, কেন্দ্র, তার সঙ্গে আবার রাজ্য, রাজ্যের মধ্যে আবার কিছু স্বশাসিত এলাকা— এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোই বিচ্ছিন্নতাবাদের ধারণার জন্ম দেয়। এই কাঠামো কখনও এক রাষ্ট্রের ভাবনাকে স্বীকৃতি দেয় না। এর শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে। সংবিধান শুদ্ধ করতে হবে। এককেন্দ্রিক সরকার গঠন করতে হবে।
গোলওয়ালকরের ভাবনা ছিল, ভারতে এক দেশ, এক রাজ্য, এক আইনসভা, এক প্রশাসন ঘোষণা করতে হবে। সেখানে আলাদা ভাবে কোনও একটি বিশেষ ধর্ম, অঞ্চল বা ভাষা নিয়ে গর্ব করার জায়গাই থাকবে না। যা হবে, একটাই। সংবিধানের এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নামক ব্যাপারটা স্রেফ মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। আরএসএস প্রচারক থেকে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে উঠে আসা নরেন্দ্র মোদী যখন ‘এক দেশ, এক কর’ বা ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’-এর স্লোগান তোলেন, প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তিনি কি আসলে গোলওয়ালকরের ‘এক দেশ, এক রাজ্য, এক আইনসভা, এক প্রশাসন’-এর দিকেই পা ফেলতে চাইছেন? রাজ্যের ক্ষমতা ধীরে ধীরে কেন্দ্রের হাতে কুক্ষিগত করে ফেলাটা কি তারই অঙ্গ?
‘চক দে’-র কবীর খানের ‘টিম ইন্ডিয়া’ ও নরেন্দ্র মোদীর ‘টিম ইন্ডিয়া’-র ভাবনাটা বোধ হয় এক নয়!