নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ
দু’টি ‘ঐতিহাসিক’ মধ্যরাতের ছবি পাশাপাশি ফেলে টুইট করেছিলেন শশী তারুর, মঙ্গলবার। একটি উনিশশো সাতচল্লিশ সালের এক মধ্যরাতে জওহরলাল নেহরুর বক্তৃতার ছবি, আর একটি দু’হাজার উনিশ সালের এক মধ্যরাতে দেবেন্দ্র ফডণবীসের চুপিসারে শপথগ্রহণের ছবি। প্রেক্ষাপট, গুরুত্ব ইত্যাদি বহু রকম অসঙ্গতি আছে এই টুইট-তুলনার মধ্যে, তারুর-সুলভ দেখনদারি তো আছেই। কিন্তু আরও অতিরিক্ত কিছুও আছে। মানতেই হবে, দুটোই ‘সত্যি’ ছবি, আজকালকার মতো ‘ফেক’ কিংবা ‘ফোটোশপড্’ নয়। আর যে ছবি সত্যি, তা তো কোনও না কোনও বাস্তবের দিকে নির্দেশ করে বটেই। তাই ভাবছিলাম, কী বলতে পারে পাশাপাশি এই দু’টি ছবি?
বলতে পারে— ভারত-মা কী ছিলেন, ভারত-মা কী হয়েছেন! কোন শিখর থেকে কোন তলানিতে ডুবেছেন। রাতের বেলা অনেক প্রকারের জরুরি অবস্থাই তৈরি হতে পারে, কিন্তু দেশ যখন ঘুমে অচেতন, তখন কোন পরিস্থিতিকে এত জরুরি ঠাহরে রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপাল, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সকলে ব্যস্তসমস্ত হয়ে সরকার তৈরি করে ফেলতে পারেন! কাকপক্ষী না জাগতেই সাত-তাড়াতাড়ি সরকার তৈরি করা হবে— কোন ভাবনা থেকে এই অবস্থানে পৌঁছতে পারেন। না কি কোনও ভাবনারই দরকার পড়ে না? সর্বময় ক্ষমতাবান নরেন্দ্র মোদী, কিংবা ‘চাণক্য’ শিরোপা আদায়কারী অমিত শাহ ভেবে নেন যে, ভারতবাসী মাত্রেই তাঁদের নিয়ে এত মুগ্ধ যে তাঁরা যা-ইচ্ছে-তাই করে গেলেও সকলে হইহই রবে স্বাগত জানাবেন? এই একটি রাত্রিকালীন তৎপরতার মধ্যে কত রকমের অসাংবিধানিকতা আছে যে তার হিসেব করাই মুশকিল।
তারুর ওই ছবি দুটো পাশাপাশি দিয়ে স্বভাবসিদ্ধ নাটুকেপনা করেছেন ঠিকই, কিন্তু মূল কথাটা ঠিকই বুঝিয়েছেন। যে গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন দিয়ে উনিশশো সাতচল্লিশের রাত ভোর হয়েছিল, এত দিনে তা তুমুল কোনও বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছে। গণতন্ত্রের নামে যা পড়ে আছে আমাদের চার পাশে, তার জন্য একটা শব্দই উপযুক্ত। না, পরিহাস নয়। সেই শব্দটা হল— বিভীষিকা।
পরিহাস কথাটার মধ্যে একটা লঘুতার দ্যোতনা আছে। কিন্তু এত দিনে, কর্নাটক থেকে লোকসভা হয়ে মহারাষ্ট্র— একের পর এক নির্বাচন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া বলে দেয়, ব্যাপারটা মোটেই রসালো নয়, বরং বেশ নীরস, নীরক্ত, ভয়ঙ্কর। এই কারণেই নরেন্দ্র মোদীরা যখন অমিত শাহকে ‘চাণক্য’ বলেন, তার মধ্যে শুধু বুদ্ধিহীনতা আর অজ্ঞানতা দেখতে পাই না, একটা হাড়-হিম করা অনৈতিকতা দেখি। কিছুমাত্র না জেনেই চাণক্যকে এক রাজনৈতিক গুন্ডার স্তরে নামিয়ে আনার ফন্দি দেখি। উল্টো দিকে যখন রণদীপ সুরজেওয়ালার মতো বিরোধী নেতারা বলেন, মোদী ও শাহকে দেখে মনে পড়ছে দুর্যোধন ও শকুনির কথা, তখনও বড্ড দুশ্চিন্তা হয়। এই সব এলোমেলো অর্থহীন উপমার ঘায়ে আসল বিপদের পর্বতসমানতাটা হারিয়ে যাচ্ছে না তো? হ্যাঁ, ঠিকই, যে কোনও রাজনীতির মধ্যেই একটা দুর্বৃত্ত দিক থাকতে পারে, যে কোনও সময়েই। কিন্তু দুর্বৃত্তপনারও রকমভেদ, পরিমাণভেদ, উচ্চতাভেদ হতে পারে। আজকের ভারত রাজনীতি ও সমাজের যে দুর্বৃত্তায়ন দেখছে, তা আগে কল্পনীয়ই ছিল না।
কংগ্রেস বা সিপিএম বা তৃণমূলের অজস্র অন্যায়ের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য অনেকেই উদ্গ্রীব আছেন, থাকবেন। কিন্তু কেবল ভারতীয় দলগুলোই বা কেন। গণতন্ত্রের মহান উদ্ভাবন যে সব দেশে ঘটেছিল সেখানেও গণতন্ত্রের গোড়ার দিন থেকে ঘোড়া কেনাবেচার প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছে। অন্য দিকের লোককে যেন তেন প্রকারেণ নিজের দিকে নিয়ে আসার প্রবণতা তো সব রাজনীতিতেই। গণতন্ত্রের রাজনীতিও তার থেকে বেরোতে পারেনি। সাধে কি পার্লামেন্ট বস্তুটাকে সকৌতুকে ‘হাউস অব কার্ডস’ বলে! উনিশ শতকের আমেরিকার প্রবাদপ্রতিম প্রেসিডেন্ট এব্রাহাম লিঙ্কনও স্থির করেছিলেন যে কোনও মূল্যেই হোক, দেশ থেকে ‘দাসপ্রথা’ উঠিয়ে দেওয়ার জন্যে ‘যা করতে হয় করবেন’ (‘এনি মিনস নেসেসারি’)। বিপক্ষের নেতাদের বুঝিয়েশুনিয়ে, কিংবা চাপ দিয়ে, কিংবা টোপ ফেলে, নিজেদের পক্ষে আনবেন। তখনকার এক পার্লামেন্টারিয়ান লিখেছিলেন, ‘‘দ্য গ্রেটেস্ট মেজ়ার অব দ্য নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি ওয়জ় পাসড বাই করাপশন এডেড অ্যান্ড অ্যাবেটেড বাই দ্য পিয়োরেস্ট ম্যান ইন আমেরিকা।’’ কিন্তু পথ যতই এক রকমের হোক, লক্ষ্যটা ইতিমধ্যে বহুলাংশে এবং মৌলিক ভাবে পাল্টেছে। ওই পরিবর্তনটা খেয়াল করা খুব জরুরি কাজ।
এত দিন আমরা দেখেছি রাজনীতিতে মানুষকে নেতৃত্বদানের একটা পদ্ধতি ছিল। পদ্ধতি না থাক, তেমন একটা ইচ্ছা ছিল। সামনে কোনও গন্তব্য আছে, এমন একটা বিশ্বাস ছিল। বিশ্বাস না থাক, চার পাশটার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ ছিল। কিন্তু এই সব কিছু ছাড়িয়ে, মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ভয় দেখিয়ে ‘সিস্টেম’ বা ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত রাখাটা এত নির্লজ্জ রকমের স্পষ্ট ছিল না কোনও দিন। কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য ‘নৈতিক’ ভাবে সমর্থনীয়, আর কোনটা নয়, তা নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক হতে পারে। কিন্তু যত ক্ষণ একটা ‘রাজনীতি’ আছে, তত ক্ষণ সে সবই একটু গুরুত্বসহকারে গ্রহণীয়। কিন্তু সমস্ত ‘রাজনীতি’ অতিক্রম করে কেবল সবার চোখে ধুলো দেওয়ার ‘ছলবলকৌশল’টা কোনও নীতি হতে পারে কি?
আসল কথা, কোনও কোনও অনৈতিকতা বিতর্কের ঊর্ধ্বে। ভোটের নামে মানুষকে গ্রামেশহরে হাটেবাজারে বিধানসভায়-লোকসভায় ‘কিনে ফেলা’র পদ্ধতিটা যে পুরোদস্তুর প্রস্তরযুগীয় বর্বরতা, তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে না। এই বর্বরতাকে রাজনীতি বলা যায় না এই জন্যই যে এর কোনও ‘নীতি’ নেই, আছে শুধু ‘অস্ত্র’। প্রথম অস্ত্র, বিপুল পরিমাণ টাকা ছড়ানো। দ্বিতীয় অস্ত্র, যে কোনও প্রকারে ভয় দেখানো। তাই মহারাষ্ট্রে যা ঘটে গেল, তাকে নেহাত ‘ঘোড়া কেনা-বেচা’ বলে সাধারণ রাজনীতির ধরনধারণের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। ও পাপ অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু বর্তমান ভারতের রাজনীতিতে অর্থব্যবসা যে কুৎসিত পর্যায় ছুঁয়েছে, এবং হুমকি-হামলা পন্থা যে নির্লজ্জতায় পৌঁছেছে— তা অভূতপূর্ব।
এই নেতাদের কাছে আমজনতা হল কীটাণুকীটের মতো। তাঁরা ভাবেন— তাদের ভুল বোঝানো বাঁ হাতের খেল। তাই রাজ্যে রাজ্যে রাজ্যপালকে এই ভাবে প্রকাশ্যত দলভৃত্যে পরিণত করা হয়। রাষ্ট্রপতিকে গভীর রাতে উঠিয়ে তাঁকে দিয়ে স্বাক্ষর করানো যায়। একের পর এক রাজ্যে সহস্র কোটি টাকার লোভ দেখিয়ে কিংবা মামলার ভয় দেখিয়ে বিরোধী নেতাদের কব্জা করে ফেলা যায়। বিরোধী নেতাকে রাতের অন্ধকারে নিজের পক্ষে টেনে এনে পরের দিনই তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের মামলা তুলে নেওয়া যায়। (পরের দিনই, কেননা হাতে-গরম দান-প্রতিদানটা গুরুত্বপূর্ণ।) নির্বাচনী বন্ডের ৯৫ শতাংশ একা বিজেপির দখলে, সেই কথা প্রকাশ হয়ে গেলেও বিন্দুমাত্র অস্বস্তিবোধ ঘটে না। যে দিন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মহারাষ্ট্রে সাংবিধানিক প্রথা অমান্য করে অন্যায় ভাবে সরকার গঠিত হল, তার পর দিনই সংসদে দাঁড়িয়ে সংবিধানের প্রতি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আভূমি প্রণতি জানাতে পারেন।
সর্বোপরি, এত সব অন্যায়, অনাচার, দ্বিচারিতা খর সূর্যালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেলেও তাঁরা নিতান্ত নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, কেননা তাঁরা মনে করেন মানুষের ক্ষমতাই নেই তাঁদের আটকানোর। মনে করেন যে, রাজনীতির মাঠে তাঁদের এই ব্যাপক দুর্নীতির অধিকার ও ক্ষমতা সকলে মেনে নিয়েছেন।
মনে করেন যে, যাঁরা এখনও মেনে নেননি, তাঁদের মানানোর ‘ব্যবস্থা’ করা যাবে দ্রুত। শুধু মায়াবতী বা অজিত পওয়ারদের বাগে আনাই তো নয়। অসমের এনআরসি থেকে কাশ্মীরের অতিনিয়ন্ত্রণ— সমস্ত ক্ষেত্রেই আমরা আসলে সেই একটিই মহাপন্থার প্রয়োগ দেখছি: ভয় দেখানো। নীতি মানেই এখন ভীতিপ্রদর্শনের কলাকৌশল। দৃষ্টি মানেই বার্তাপ্রদান। সেই বার্তা যে, নিজেদের সমর্থক সমাজের বাইরে অন্যদের প্রতি তাঁদের কেবল বিরাগ নেই— আছে সুতীব্র ঘৃণা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা। তাই অন্যরা সময় থাকতে সাবধান হন।
তারুরের ছবির মাহাত্ম্য এখানেই। আমাদের দেশ আসলে আবারও এসে দাঁড়িয়েছে এক ঐতিহাসিক পটভূমিকায়। রাজনীতির অধোগমন নতুন কথা নয়, অমন আমরা দেশেবিদেশে অনেক দেখেছি, শুনেছি। কিন্তু রাজনীতি বলতে যা জানি-শুনি-বুঝি, তার মৌলিক ‘নৈতিক’ সীমারেখাগুলো আগে কখনও এত দ্রুত বেগে পেরিয়ে যাইনি আমরা।
তবে কিনা, একটাই আশা থাকে এত কিছুর পরও। শাসকরা যা-ই ভাবুন না কেন, এ দেশে অতঃপর নৈতিক রাজনীতি বলে কিছু থাকবে কি না— তাঁরা নন— শেষ পর্যন্ত তা ঠিক করবেন মানুষই। ভয় দেখানো জারি থাকলেও সকলে ভয় পাবেন, না কি সদলবলে রুখে উঠবেন, তা স্থির করে নেবেন মানুষই।