ডোনাল্ড ট্রাম্প।ছবি: সংগৃহিত
রাহুমুক্তি: আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনকে যে এই ভাবে ভাবিতেছেন সে দেশের এবং সমগ্র বিশ্বের বহু মানুষ, তাহা অকারণ বলা যাইবে না। বিভিন্ন কারণেই বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গত চার বৎসরের শাসনকাল স্মরণীয় হইয়া থাকিবে, এবং প্রায় প্রতিটি কারণই বিষম উদ্বেগজনক। বিদ্বেষ-রাজনীতি হইতে শুরু করিয়া দায়িত্বরহিত স্বাস্থ্যনীতি, অগণতান্ত্রিক আচারবিচার হইতে শুরু করিয়া অনৈতিকতা ও দুর্নীতি, সকল ক্ষেত্রেই ট্রাম্প-জমানা এক অভূতপূর্ব অবনমনের সাক্ষী রহিল। বিজয়ী ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট জো বাইডেন যে বিরাট মাপের রাজনীতিক কিংবা সুদক্ষ দেশ-পরিচালক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করিবেন, এমন আশা করা মুশকিল। তবু গত চার বৎসরের কালিমালিপ্ত রাজনীতি ও সমাজনীতি যে একই অভিমুখে চলিবে না, বাইডেনের বিজয়-সংবাদে অন্তত এই স্বস্তিবোধ ঘটিতেছে। ব্যক্তি-স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায় এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আর এক বার ফিরিয়া পা রাখিবার সম্ভাবনা দেখিতেছে আমেরিকা। সম্ভাবনার কতখানি ফলপ্রসূ হইবে, তাহা দেখিবার। কিন্তু সম্ভাবনাটিও কম সুসংবাদ নহে। প্রতি দেশেই প্রতি বার কোনও জাতীয় নির্বাচনের আগে তাহাকে মহা গুরুত্বপূর্ণ ভাবিবার একটি চল আছে। কিন্তু এই বারের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্বের গুরুত্ব যে বাস্তবিকই আকাশচুম্বী ছিল, তাহার কারণ এইখানেই নিহিত। ডোনাল্ড ট্রাম্প এক অসামান্য ‘কৃতী’ পুরুষ। গণতন্ত্র নামক ব্যবস্থাটিকে তিনি যে ভাবে ঘাড় মটকাইয়া দিবার বন্দোবস্ত করিতেছিলেন, তাহা বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের আবহ তৈরি করিয়াছিল।
ইতিহাসের শিক্ষা বলে, কোনও ব্যক্তিই একক নহেন, সকলেই নিজ নিজ স্থান ও কালের চিহ্নক বহন করেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বেচ্ছাচারও তাঁহার সমাজের, তাঁহার সমর্থক-সমষ্টির মধ্যে ওতপ্রোত প্রবাহিত। বিদ্বেষ ও অনৈতিকতার প্রবল শক্তি আমেরিকান সমাজের মধ্যে প্রোথিত না থাকিলে ট্রাম্পও তৈরি হইতে পারিতেন না। এ বারের নির্বাচনেও উদারবাদী আমেরিকা নিশ্চয় ত্রস্ত বোধ করিতেছে, ট্রাম্পের পক্ষে বিপুল পরিমাণ জনসমর্থন দেখিয়া। বাইডেনের বিজয় ট্রাম্পকে সরাইয়া দিলেও ট্রাম্পিয়ানা-কে পরাস্ত করিতে পারে নাই। তাহা রহিয়া গেল, প্রবল ভাবে রহিয়া গেল। প্রতি পদে বাইডেনের আমেরিকা আগামী কয়েক বৎসর ট্রাম্পের আমেরিকার মোকাবিলা করিবে।
তবুও অনস্বীকার্য, সামগ্রিক বশ্যতাস্বীকারের তুলনায় মোকাবিলা ও সংঘর্ষের উদ্বেগও অধিক বাঞ্ছনীয়, কেননা তাহাতে কিছু আশা অবশিষ্ট থাকে। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় কেবল আমেরিকা কেন, গণতান্ত্রিক বিশ্বের পক্ষেই একটি সুসংবাদ। ভারতের পক্ষেও। প্রসঙ্গত ভারতের রাজনীতির সহিত আমেরিকার রাজনীতির প্রত্যক্ষ সংযোগ না থাকা সত্ত্বেও ইহা মানিতেই হইবে যে, আমেরিকার বিশ্ববীক্ষায় ভারত এখন আর কোনও প্রান্তিক দেশ নহে। একবিংশ শতকের গোড়া হইতেই ভারতের সংজ্ঞা আমেরিকার নিকট পাল্টাইতে শুরু করিয়াছে, ইসলামি বিশ্ব ও চৈনিক বিশ্বের প্রেক্ষাপটের সুবাদে। ট্রাম্পের আমেরিকার নিকটও যেমন, বাইডেনের আমেরিকার সহিতও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক তাই একই ছন্দে চলিবার কথা। তবে রাজনৈতিক দিক দিয়া নরেন্দ্র মোদী সরকারের সহিত ট্রাম্প সরকারের যে নৈকট্য ছিল, তাহার ছন্দ কিছুটা পরিবর্তিত হইবার সম্ভাবনা। বাইডেন একাধিক বার মোদী সরকারের কাশ্মীর নীতি কিংবা নাগরিকত্ব বিধির প্রকাশ্য সমালোচনা করিয়াছেন, ভারতে ক্রমহ্রাসমান নাগরিক স্বাধীনতার বিষয়ে উদ্বেগ ব্যক্ত করিয়াছেন। আমেরিকার নূতন প্রেসিডেন্ট সে দেশের রাজনীতি এবং কূটনীতির দিশা পাল্টাইবেন কি না, কতটা পাল্টাইবেন, কতটা পাল্টাইতে সক্ষম হইবেন, এই সবই তাই আপাতত জল্পনার স্তরে।