পুরুষের স্থান

একটি চিত্রে যাহা প্রকাশ পায়, সহস্র শব্দ তাহা বুঝাইতে পারে না। বাৎসল্যময় কিন্তু কর্মতৎপর এক প্রবীণের ছবিটি বুঝাইল, শিশুপালনের সহিত পেশাগত দায়িত্ব পালনের বিরোধ নাই, পৌরুষের মর্যাদাও তাহাতে খর্ব হয় না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৯ ০০:০১
Share:

ছবি এপি।

ট্রেভর ম্যালার্ড নিউজ়িল্যান্ডের বর্ষীয়ান রাজনীতিক, নানা মন্ত্রিত্ব সামলাইয়া এখন পার্লামেন্টের স্পিকার। তাঁহাকে লইয়া বিশ্ববাসীর ঔৎসুক্য-উদ্দীপনার কোনও কারণ এত দিন ঘটে নাই। আজ একটি ছবির জন্য তাঁহার নাম মুখে মুখে। তাহাতে ম্যালার্ড পার্লামেন্টে স্পিকারের আসনে বসিয়া আলোচনা পরিচালনা করিতেছেন, এবং একই সঙ্গে দুধের বোতল ধরিয়াছেন এক শিশুর মুখে। শিশুটি পার্লামেন্টের অপর এক সদস্যের সন্তান। সে দিন সভায় বসিয়া ম্যালার্ড দুধ খাওয়াইয়া, মৃদু দুলাইয়া শিশুকে শান্ত রাখিয়াছেন, আবার নির্ধারিত সময় অতিক্রম করিবার জন্য বক্তৃতারত সদস্যকে সতর্কও করিয়াছেন। পঁয়ষট্টি বৎসরের এক পুরুষ তাঁহার কর্মক্ষেত্রে এক শিশুর পরিচর্যা করিতেছেন, দেখিয়া কে না আশ্চর্য হইবে? ‘আইনসভা চলিতেছে’ বলিলে ভারতীয়দের মনে ফুটিয়া ওঠে এক রণক্ষেত্রের ছবি। কোনও দেশের আইনসভা যে শিশুর উপযোগী পরিবেশও হইতে পারে, বিতর্ক ও শিশুপালন একসঙ্গে চলিতে পারে, ভারতবাসীর তাহা সহসা বিশ্বাস হইবে না। সর্বোপরি, এক বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা যে তাঁহার সংবিধান-নির্দিষ্ট দায়িত্বের সহিত সমান মর্যাদা দেন একটি শিশুকে সুস্থ ও শান্ত রাখিবার দায়কে, তাহাতে পুলকিত না হইয়া উপায় কী?

Advertisement

একটি চিত্রে যাহা প্রকাশ পায়, সহস্র শব্দ তাহা বুঝাইতে পারে না। বাৎসল্যময় কিন্তু কর্মতৎপর এক প্রবীণের ছবিটি বুঝাইল, শিশুপালনের সহিত পেশাগত দায়িত্ব পালনের বিরোধ নাই, পৌরুষের মর্যাদাও তাহাতে খর্ব হয় না। তেমনই, একটি কাজে যাহা প্রমাণ হয়, সহস্র বিচার-বিতর্ক করিয়া তাহার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। গৃহকার্যে বা শিশুপালনে পুরুষদের ভূমিকা থাকা উচিত কি না, থাকিলে তাহার পরিমাণ কতখানি হইবে, নারীর সমান না কি কিছু কম, সে বিষয়ে কম বাক্-বিতণ্ডা হয় নাই। কাজ অবশ্য সামান্যই হইয়াছে। ব্রিটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আজ পুরুষ যত গৃহকর্ম করে, নারী করে তাহার দেড়গুণ হইতে দ্বিগুণ। ভারতের অবস্থা অতিশয় লজ্জাজনক। এ দেশে মহিলারা প্রায় ছয় ঘণ্টা গৃহস্থালি ও শিশু-বৃদ্ধদের পরিচর্যার কাজ করিয়া থাকেন, পুরুষেরা করেন এক ঘণ্টারও কম। এমন অসাম্য হইতেই এই ভ্রান্ত ধারণা শক্তি পায় যে, গৃহই মেয়েদের উপযুক্ত স্থান। ম্যালার্ড কর্মক্ষেত্রকে শিশুর উপযুক্ত স্থান, শিশুর পরিচর্যাকে পুরুষের উপযুক্ত কাজ বলিয়া কত সহজে দেখাইয়া দিলেন। নারী-পুরুষ বৈষম্যকে ‘স্বাভাবিক’ প্রতিপন্ন করিতে পুরুষতন্ত্র কত না যুক্তি দিয়া অভেদ্য প্রাচীর গড়িয়াছে। একটি ছবি দেখাইয়া দিল, সেগুলি নেহাত বালির বাঁধ। ম্যালার্ড বুঝাইলেন, সাম্যের প্রতিষ্ঠা কেবল তাত্ত্বিক আলোচনার কাজ নহে। দৈনন্দিন আচরণ দিয়া সে কাজটি করিতে হয়।

কেহ বলিতে পারেন, সংসদ ভবনে শিশুক্রোড়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবিও তো প্রকাশিত হইয়াছে। তখন এত প্রশংসা হয় নাই কেন? উত্তর, শিশুর সহিত খেলা আর শিশুর পরিচর্যার মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। তদুপরি, নিউজ়িল্যান্ডের যে পার্লামেন্ট-সদস্য ওই শিশুটির পিতা, তিনি সমকামী বিবাহে আবদ্ধ। সন্তানের জন্ম হইয়াছে গর্ভদাত্রীর সহায়তায়। এমন দাম্পত্য, এমন অভিভাবকত্বের প্রতি বিশ্ববাসীর সম্মান আদায় করিল ম্যালার্ডের ছবি। নরেন্দ্র মোদী সমকামীদের সমাদর করিতেছেন, এমন দেখা গেলে হয়তো ভারতও এমন প্রশংসনীয় হইবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement