‘বিয়ের গীত’-এর সেই রমরমা আজ নেই...

সেরিনা বা রওশনারারা এখনও ‘বিয়ের গীত’ গাইলেও মানতে বাধ্য হন যে ‘বিয়ের গীতে’র সেই রমরমা আজ আর নেই। তাঁদের গলায় এখন বেদনার সুর। এখন বীরভূমের কিছু কিছু গ্রামে বিয়ের গান গাওয়ার রেwওয়াজ থাকলেও বেশির ভাগ অঞ্চলে কিন্তু আর সেভাবে গাওয়া হয় না। লিখছেন রেইনি চৌধুরী।মুসলিম বিয়ের গান বাংলার লোকসাহিত্য ও লোকসঙ্গীতকেও সমৃদ্ধ করে নানাভাবে একথা যেমন সত্যি তেমনই মুসলিম সমাজে বিয়ের গান নিয়ে নানা সমস্যাও আছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৯ ০২:৪৭
Share:

বিয়ের গানের আসর।

বাঙালি সংস্কৃতিতে লোকসঙ্গীতের যে কয়েকটি ধারা ক্রমান্বয়ে লোকসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে তার মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের ‘বিয়ের গীত’ অন্যতম। প্রচলিত এবং তাৎক্ষণিকভাবেও রচিত এই গানগুলি লোকসংস্কৃতির এক অমূল্য ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যদিও মুসলিম সমাজ ব্যবস্থায় সঙ্গীত পরিবেশনের বিপক্ষে নানা মত রয়েছে। তবুও দীর্ঘকাল ধরে অধিকাংশ মুসলিম পরিবারে বিভিন্ন উৎসব-আনন্দে সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে ওতপ্রোতভাবে মিশে রয়েছে সঙ্গীত।

Advertisement

মুসলিম বিয়ের গান বাংলার লোকসাহিত্য ও লোকসঙ্গীতকেও সমৃদ্ধ করে নানাভাবে একথা যেমন সত্যি তেমনই মুসলিম সমাজে বিয়ের গান নিয়ে নানা সমস্যাও আছে। শরিয়তপন্থীরা এই ধরনের রীতি, বিশেষত গান পছন্দ করেন না। কারণ বিয়ের গানের সঙ্গে আবার বাজনাও বাজানো হয়, কোথাও কোথাও যুক্ত হয় নাচও। অঞ্চলভিত্তিক ভাবে এই গানের তফাৎও হয়। কিছু ক্ষেত্রে মুসলিম পুরুষদের আপত্তি থাকলেও নেহাতই পরিবারের মহিলাদের জোরাজুরিতে বিয়ের গানের আসর বসে এখনও। যদিও এই রীতিতে পুরুষেরা ব্রাত্যই। কারণ বিয়ের গান মানেই মহিলারা করেন।

তবে, এ কথা মানতেই হয় ২০২০ সালের গোড়ায় দাঁড়িয়ে মুসলিম বিয়ের আনন্দে নিয়ম-কানুন কিছু শিথিল হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। আর তাতেই বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে এই গান। মুসলিম সমাজে নানা ধরনের অনুষ্ঠানে গান পরিবেশনের রীতি প্রচলিত ছিল বহু আগে থেকেই, এখনও কিছু কিছু আছে। মুসলিম সমাজে হামদ, নাত, মুর্শিদি, মারফতি, ফকিরি ইত্যাদি নানা ধরনের সঙ্গীত বহু যুগ ধরে গাওয়া হয়। জিকির, মুসলমানি, ক্ষীর খাওয়ানো ইত্যাদি অনুষ্ঠানে এক সময় ব্যাপকভাবে গান গাওয়ার রেওয়াজ ছিল। এ সবের মধ্যে অবশ্য মুসলিম সমাজে সব চেয়ে উল্লেখ্য এই ‘বিয়ের গীত’।

Advertisement

বিয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে যেমন গায়ে হলুদ, আইবুড়ো ভাত, ওয়ালিম-সহ নানা আয়োজনকে কেন্দ্র করে গানগুলি রচিত ও গীত হয়। এই সব বিয়ের গীতে শুধু চিত্ত-বিনোদনই থাকে তা নয়, এর মধ্যে মুসলিম মহিলাদের ও মুসলিম সমাজের নানা সুখ, দুঃখ, বেদনা, আনন্দের কথাও প্রকাশিত হয়, প্রকাশিত হয় নানা প্রথা ও ঐতিহ্যের পরম্পরাও। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক রীতি অনুযায়ী বিয়ের গীত পরিবেশিত হয়। বাংলাদেশ-সহ বেশ কিছু অঞ্চলে বিয়ের দিনে বর আসার আগে থেকে শুরু হয় এই গান। বিয়ের নানা পর্যায়ের জন্য নানা ধরনের ‘গীত’ ভাগ করা আছে। আর গানের প্রতিপাদ্য বিষয়ে আছে বিয়েকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পক্ষ থেকে নানা কথাবার্তার উল্লেখ। যেমন বর আসার আগে প্রতিবেশীরা বলছে – “দুলহন সাজাও আম্মা খুবসুরত করিয়া/ দামান আসিছে দেখি পাগড়ি নাড়িয়া।” মা আবার প্রতিবেশীদের উত্তর দিচ্ছেন গীতের মধ্যেই – “আসুক নারে পুতার দামান, চিন্তার নাই কিছু/ কামরঙা রঙ পাটি পিঁধে বেটি যাবে পিছু পিছু।” বর এসে পৌঁছালে, বর দেখে এসে বাড়ির মেয়েমহলে বরের রূপ বর্ণনা করার রেওয়াজও খুব জনপ্রিয় ছিল মুসলিম গীতের মধ্যে – “কোথায় গিলা পুতের মা/ দামান দেখো আইয়া/ রূপের বান ডাইকা দিল/ কত মিস্টি লইয়া।”

আবার বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া জেলা-সহ অনেক জায়গায় বিয়ের দিনে আর বিয়ের গান পরিবেশিত হয় না। বিয়ের প্রায় দিন দশেক আগে থেকে এই সব অঞ্চলে গান গাওয়া শুরু হয়। সাধারণত বাড়ির ভিতর মহিলারাই এই গান করেন। পাড়ার কোনও কোনও মহিলা এই ধরনের গানে দক্ষ থাকেন, তাঁরাই এই গান পরিবেশন করেন। কিছু গান প্রচলিত, কিছু মুখে মুখে রচিত। গীতের সঙ্গে তালবাদ্য হিসেবে থাকে বাংলা ঢোল বা মাদল। এই ঢোল বা মাদল মহিলারাই বাজিয়ে থাকেন। সাধারণত ৪/৪ বা ৩/৩ ছন্দেই মুসলিম বিয়ের গীতগুলি গীত হয়ে থাকে। অর্থাৎ দাদরা, খেমটা, কাহারবা - এই তিনটি তালেই মূলত গাওয়া হয় মুসলিম বিয়ের গীত। তবে যাঁরা এই গানের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র বাজান তাঁরা মোটেও জানেন না তালগুলির বোলবাণী সম্পর্কে। আসলে যাঁরা এই গানগুলি গেয়ে থাকেন আর যাঁরা এই গানের সঙ্গে সঙ্গত করেন, তাঁদের গান-বাজনার প্রথাগত তেমন কোনও তালিম কোনও কালেই ছিল না, আজও নেই। পুরোটাই নিজস্ব তালজ্ঞান ও অনুভব থেকে সম্পন্ন হয়।

বর্ধমান জেলার পিণ্ডিরা গ্রামে আমিনা বিবির লেখা একটি বিয়ের গীত খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এক সময় লোকমুখে। গানের প্রথম পঙক্তিটি হল -

‘কেন ভাঙলি রে তুই চারা গাছের আম?

ওরে বেহুদা গোলাম।’

সিউড়ি শহরের হ্যারিয়েট গঞ্জ এলাকার রওশনা বিবি এখনও বিয়ের গীত পরিবেশন করেন। তাঁর একটি গানের কয়েক পঙক্তি - ‘আমার আচিঁলে পাচিঁলে কে টুকি মারে / আমার স্বামী নাই ঘরে। / আমার বন্ধু গিয়েছে মালা গড়াইতে / তাই সে নাই যে রে ঘরে/ আমার আচিঁলে পাচিঁলে কে টুকি মারে...।’

রওশনার আর একটি গানের পঙক্তি – ‘ওরে ও সাম্পানওয়ালা তুই আমায় করলি দিওয়ানা / কাজরার কয়লা কালো / সিউড়ির মেয়েরা ভাল / কিনে দিতে হবে চুড়ি আর কিছু না...।’

সিউড়ির আর এক বিয়ের গীত গাইয়ে প্রবীণ সেরিনা বিবির গানে আবার অন্য রকম বৈচিত্র পাওয়া গেল। এক সময় বাংলা আধুনিক গানের সুরের প্রভাব যে মুসলিম বিয়ের গানেও পড়েছিল তা সেরিনা বিবির গান শুনলে বোঝা যায়। আজ থেকে বছর তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের বেতারে বা মাইকে শোনা স্বর্ণযুগের আধুনিক গান ও তার সুর অনেকখানি প্রভাবিত করেছিল মুসলিম বিয়ের গানকে। শ্যামল মিত্রের ‘কী নামে ডেকে’ গানের সুরে সেরিনা বিবি তৈরি করেছেন তাঁর ‘বিয়ের গীত’ – ‘কী নামে ডেকে, বলব বিয়াইকে/ তোমার ছোট মেয়ে দিবে আমাদের ঘরে।/ ঘড়ি নিব সাইকেল নিব/ নিব মাকুড়ি,/ বউ হবে ছোট পারা /খুব সুন্দরী....।’ আবার মান্না দে’র ‘ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না’ গানের সুরকে হুবহু অনুসরণ করে সেরিনা গেয়ে ওঠেন - ‘ও সুন্দরী তুই এই শাদি আসরে আয় না/ মেহেদী দিয়ে সাজিয়ে দিব, গায়ে দিব গয়না।/ তুকে নিয়ে কতই না / দেখেছি খুয়াব / তুই হলি আমার এই / দিলেরই গুলাব। / আর কুনো বাত নয় / তুকে ছাড়া দিল আর কিছু তো চায় না।’

সেরিনা বা রওশনারারা এখনও ‘বিয়ের গীত’ গাইলেও মানতে বাধ্য হন যে ‘বিয়ের গীতে’র সেই রমরমা আজ আর নেই। তাঁদের গলায় এখন বেদনার সুর। এখন বীরভূমের কিছু কিছু গ্রামে বিয়ের গান গাওয়ার রেওয়াজ থাকলেও বেশির ভাগ অঞ্চলে কিন্তু আর সেভাবে গাওয়া হয় না। গায়িকাও কমে গিয়েছে, আর এই রীতিও হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ এই কারণে। কিছু জায়গায় হিন্দি ও বাংলা সিনেমার গান বাজিয়ে বিয়ের আগে আনন্দ করার চাপল্য প্রচলিত হচ্ছে মুসলিম সমাজেও। কোথাও আবার বিষয়টি বাণিজ্যিকভাবে সামনে আনা হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে বিয়ের গীত গাইবার দলও তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেটে দেখা যায় হারমোনিয়াম সহযোগে ‘মুসলিম বিয়ের গীতে’র ভিডিও, তবে এর মধ্যে কিন্তু সেই পুরনো বিয়ের গানের গন্ধ খুঁজে পাওয়া য়ায় না। সব মিলিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে কোথাও কোথাও বিয়ের গান গাওয়া হলেও আসতে আসতে সুর হারাচ্ছে লোক সংস্কৃতির ধারক, বাহক মুসলিম ‘বিয়ের গীত’। সেরিনা-রওশনারাদের সময় পেরিয়ে গেলে হয়তো বিলীনই হয়ে যাবে লোকসংস্কৃতির এই ধারাটি।

লেখিকা সাহিত্য ও নাট্যকর্মী, মতামত নিজস্ব

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement