আসানসোলের অশান্তির পর প্রতি বারের মতো এ বারও বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব একটি সংসদীয় দল পাঠালেন রাজ্যে। সেই প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য শাহনওয়াজ হোসেন। ভাগলপুরের সুন্নি নেতা, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তাঁর স্ত্রী রেণু জন্মসূত্রে হিন্দু। শাহনওয়াজকে চিনি ত্রিশ বছর ধরে। ফি বছর ইদের দিন তাঁর বাড়ির বিরিয়ানি তো এই ভোজনরসিক বঙ্গসন্তানের তীব্র আকর্ষণের গন্তব্য। এ হেন শাহনওয়াজের বেশ কিছু দিন থেকেই মনটা ভাল নেই। কানপুরের শিয়া নেতা মুখতার আব্বাস নকভি-র বাজার খুব ভাল। কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক দফতরের মন্ত্রী, রাজ্যসভায় দলের উপনেতা। সেখানে শাহনওয়াজ নিজের রাজ্য বিহারেও রাজ্য রাজনীতিতে কোণঠাসা। এ বার আসানসোল সফরের পর শাহনওয়াজ বেশ উৎসাহিত। তাঁকে ঘন ঘন বাংলায় যেতেও বলা হচ্ছে। বললেন, ‘‘দাদা ২০১৯-এ ভাজপা পশ্চিমবঙ্গে ২২টা আসন পাবে। শুকরিয়া দিদিকো। দিদি যত মাইনরিটি রাজনীতি করবেন, আমরাও ততই বাড়ব।’’
বললাম, এত সহজ নয়। তোমাদের লড়াইটা তো পশ্চিমবাংলায় মমতার সঙ্গে নয়। বিজেপির লড়াই তো ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সঙ্গে। শ্রীচৈতন্যদেবের সঙ্গে। ভোটটা তো দেবে বাঙালি। আমি শাহনওয়াজকে বলেছিলাম, নোয়াখালির দাঙ্গা থেকে কলকাতার গণহত্যার কুস্মৃতির জল-কাদা-আবর্জনা ঘেঁটে হাঁটতে হাঁটতে বাঙালি আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থানে বাঙালির হিন্দুধর্ম রাজনৈতিক হিন্দুত্বের সংকীর্ণ মোহজালে কিছুতেই বদ্ধ হবে না।
মানছি, বাংলার ইতিহাসেও হিন্দু ও মুসলিম, দুই শিবিরেই সাম্প্রদায়িকতাবাদ ছিল। অনেকে বলেন, বাঙালির মধ্যে একটা লুকোনো সাম্প্রদায়িকতা আছে। মানছি, ১৯৩৬ সালে যখন প্রথম বিধান পরিষদের ভোট হয়, তখন মুসলিম লিগের ভোট ছিল ১১৩। আর কংগ্রেস পায় ৮৬টি ভোট। অথচ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে, মানে সীমান্ত গাঁধীর এলাকায় কংগ্রেস ৩০টা আসন পায়, মুসলিম লিগ ১৭টা। ’৩৬ সালের এই নির্বাচনী ফলাফলই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। এই ইতিহাসের প্রেক্ষিতে মনে হতে পারে, হয়তো বাংলায় আজও সাম্প্রদায়িক বিভাজন আছে, ভোট ব্যাঙ্কও আলাদা। কাজেই মেরুকরণ সফল হতে পারে, সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতির অ্যান্টিথিসিস হয়ে দাঁড়াতে পারে বিজেপির হিন্দুত্ব।
মানছি, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমানেরা পরস্পর সম্পর্কে জানেন কম। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, বঙ্কিমচন্দ্র এবং সৈয়দ আমির আলি, দু’জনেই হুগলি মহসীন কলেজের ছাত্র ছিলেন। এক জন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, অন্য জন হাইকোর্টের বিচারপতি। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পাঁচিল থাকলেও তা শেষ সত্য নয়। মহাভারতে যেমন যুদ্ধ এবং হিংসা থাকলেও শেষ পর্যন্ত অনাসক্ত কর্ম, শান্তি, ধর্ম ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সঙ্ঘ পরিবার আজও ভাবছে বঙ্কিমকে অস্ত্র করে বাংলায় মেরুকরণ সম্ভব। বঙ্কিমচন্দ্রকে মুসলমান-বিদ্বেষের জন্মদাতা বিষবৃক্ষ বলে চিৎকার করে প্রচার করার মধ্যে সে দিনও ছিল রাজনীতি। ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, বঙ্কিম মুসলমানবিরোধী ছিলেন না।
১৮৫৭-র আগেও বাংলায় হিন্দুধর্মকে অভিজাত ইংরেজি-শিক্ষিত মানুষরা খ্রিস্টধর্মের আদলে প্রভাবিত করেন। রামমোহন রায় আর দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে বলা হত, সনাতন হিন্দুধর্মের ‘ইউনিটারিয়ান চার্চ’ তৈরি করছেন তাঁরা। ব্রাহ্মধর্মেরও অবদান তখন অনেকটাই ছিল। কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও তার পর স্বামীজি বোঝালেন, আমাদের হিন্দুধর্মের কোনও প্রতিষ্ঠাতা নেই। কোনও আব্রাহাম, কোনও নানক, কোনও জিশুখ্রিস্ট নেই। আজ যে সব মূর্তি পুজো করা হয়, সে সব দেবদেবী ঋগ্বেদে পূজিত হতেনই না। মধ্যযুগে চৈতন্যদেব তো ভক্তিবাদে ধর্ম ও জাতপাতের দেওয়াল ভেঙে দিয়ে হিন্দুধর্মকে পুনঃস্থাপিত করেন, রক্ষা করেন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের হেজিমনি থেকে, ঠাকুর তো সেই সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের ভাবনা বাঙালিকে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। কংগ্রেসও কিন্তু দেশভাগের পর সব ধর্ম সমভাবের মানসিকতা নিয়েই এগোতে চেয়েছে, যার প্রেরণা ছিল খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন ধারার মধ্যে সংযোগ ও সমন্বয় সাধক ‘ইকিউমেনিজম’-এর ধারণা। তারই আধুনিক রূপ হল সেকুলারিজম। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সনাতন ধর্মের কট্টরবাদী ধারার মৃত্যু হয়। বিনায়ক দামোদর সাভারকর নিজে নাস্তিক হলেও ভারতকে ‘হিন্দুজাতির ভৌগোলিক রাষ্ট্র’ বলে হিন্দুত্ব নামক এক রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের জন্ম দিলেন। তা হল হিন্দু মহাসভা। তাঁর মতে ভারত হিন্দুদের কাছে মাতৃভূমি। আর অহিন্দু অন্য সম্প্রদায়ের কাছে এটি মাতৃভূমি নয়, তবে বসবাসের জন্য পুণ্যভূমি। হিন্দু মহাসভার সঙ্গে অবশ্য আরএসএস ও পরে জনসঙ্ঘের মতপার্থক্য হয়। কিন্তু সব কিছু পেরিয়ে আজকের যে রাজনৈতিক হিন্দুত্ব, তা কার্যত ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি।
বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশকে জনসংখ্যাবিদ আশিস বসু নাম দিয়েছিলেন ‘বিমারু’। এ সব রাজ্যে আধুনিক হিন্দুত্বের পরীক্ষানিরীক্ষা জনপ্রিয় হয়। এই জনপদগুলিতে বিজেপির শ্রীবৃদ্ধি হয় রামমন্দির আন্দোলনের মাধ্যমে। এ সব রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যাও অনেক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ও কেরল, এই দুই রাজ্যেও সংখ্যালঘু জনসমাজ শক্তিশালী, সেখানে বিজেপি দীর্ঘ দিন ধরে চেষ্টা করেও রাজনৈতিক সফলতা পায়নি। এ-ও খুব বড় সত্য, রাজ্যে উন্নয়ন হলে এবং আর্থসামাজিক চিত্রটি ইতিবাচক হলে গোষ্ঠী সংঘর্ষও কমে। কারণ হিংসার কুশীলব মূলত কর্মহীন হতাশ বেকার ও লুম্পেন সমাজ। শাসক দল যখন যে, এই অসংগঠিত সমাজ তার ছত্রতলে থেকে বাঁচার চেষ্টা করে।
সিপিএমের পর তৃণমূলের শাসন পশ্চিমবঙ্গে। জাতীয় স্তরে যেমন উন্নয়ন ভোটের প্রধান অ্যাজেন্ডা নয়, তেমনই রাজ্য স্তরেও নয়। মমতার শাসনে আত্মপরিচয়ের রাজনীতিও এক নয়া রূপ লাভ করেছে। মুসলমান থেকে মতুয়া, সরকারি কর্মচারী থেকে পরিচারিকা— নানা ধর্ম, নানা জাত, নানা পেশা, নানা ধরনের অসংগঠিত সত্তা ভোটব্যাঙ্কে পরিণত। ফলে মতাদর্শ নয়, উন্নয়ন নয়, ভোট জেতার জন্য মমতা নামক ব্যক্তিপরিচয়ও নানা খণ্ডবিখণ্ড ভোটব্যাঙ্কের সম্মিলন। এ এক নতুন ভোট-রসায়ন। আর এই রসায়ন ভেঙে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে পাল্টা ভোট ব্যাঙ্ক গঠনে মরিয়া সঙ্ঘ পরিবার।
আমার দৃঢ বিশ্বাস, এই নেতিবাচক রাজনীতিকে বাঙালি পরাস্ত করবে। চৈতন্যদেব ও ঠাকুরের বাংলায় পরমতসহিষ্ণুতা এক চরিত্রলক্ষণ। আজ সাম্প্রদায়িকতা মানেই হিন্দু-মুসলমান। সম্প্রদায় থেকে সাম্প্রদায়িক হলে বাঙালি-অবাঙালি সংঘাতও তো সাম্প্রদায়িক। যা হোক, এত দিন পর ভাষার এই ব্যবহার বদলানো কঠিন। সাম্প্রদায়িক বিবাদে যে শুধুই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থাকে তা-ই নয়। আর তাই এ দেশে শুধু সেনা ও পুলিশ পাঠিয়ে এই অসংহতির মোকাবিলা করা যায় না। ব্রিটিশরা যেমন রাষ্ট্র ও সরকারকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছে, প্রশাসনের জন্য মানুষকে ঠিক ততটা দেয়নি। তাই আজও এই বিশাল দেশে ফৌজ দিয়ে সমস্যার সমাধানের মানসিকতা প্রবল। মানুষ কী চাইছে সেটা নিয়ে দিল্লি সে ভাবে ভাবিত নয়।
অযোধ্যা কাণ্ড থেকে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে এক লাফে কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড শুরু করতে চাইলেও কিছুতেই বাঙালি তা হতে দেবে না বলেই মনে হয়।