যে গতিতে টাকার দাম পড়ছে, তাতে গত কয়েক সপ্তাহে ভারতীয় অর্থনীতিকে সামাল দেওয়ার কাজটা রীতিমতো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর যোগ হয়েছে অপরিশোধিত তেলের দামের ক্রমাগত বৃদ্ধি। চিন্তার কারণ একাধিক— চালু খাতায় বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে, পুঁজির দেশছাড়া হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ছে। মূল্যবৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা। তার ওপর রয়েছে রাজকোষ ঘাটতির হার পথভ্রষ্ট হওয়ার ভয়। কাজেই, সমস্যাটার সুষ্ঠু সমাধান করা খুব জরুরি। মূল প্রশ্ন হল— ডলারের সাপেক্ষে টাকার দামকে স্থিতিশীল করতে, আর চালু খাতে ঘাটতির পরিমাণ কমাতে সরকারের কী করণীয়। প্রধানমন্ত্রীর ডাকা বৈঠকের সিদ্ধান্ত থেকে মনে হচ্ছে, এক দিকে অতি জরুরি নয়, এমন পণ্যের আমদানির পরিমাণে রাশ টানতে চায় আমাদের সরকার; আর অন্য দিকে ডলারে নেওয়া ঋণের পরিমাণটিও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সরকার জানিয়ে দিয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ যতখানি কমানোর লক্ষ্য স্থির হয়েছিল, তা থেকে সরে আসতে চায় না। অর্থাৎ, সরকার কতখানি বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে, কারণ সরকারি ব্যয় হ্রাস করার মাধ্যমে ঘাটতির পরিমাণ কমানোর চেষ্টা হলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওপর। এবং, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আয়বৃদ্ধির হার।
যে নীতিগুলোর কথা সরকার বলছে, সেগুলো জরুরি, কিন্তু স্বল্পমেয়াদি। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এমন কিছু কাঠামোগত সমস্যা আছে, সরকারি নীতির মাধ্যমে যার সমাধান করা চটজলদি সম্ভব নয়। ভারতের আমদানি তালিকায় সব চেয়ে ওপরে থাকা চারটি পণ্য কী?
এক, খনিজ জ্বালানি; দুই, মণিরত্ন ও দামি ধাতু; তিন, ভারী বৈদ্যুতিন যন্ত্র; এবং চার, কম্পিউটার-সহ বিভিন্ন যন্ত্র। ভারতের মোট আমদানির ৬৩ শতাংশই এই চারটি ক্ষেত্রের দখলে। তার মধ্যে, শুধু তেল আমদানিই ২৭.৭ শতাংশ। আমাদের দেশ চলে মূলত আমদানি করা তেলের ওপরেই। কাজেই, তার পরিমাণ কমানো অসম্ভব। অন্য তিনটি পণ্য চরিত্রে ইন্টারমিডিয়েট ইনপুট, অর্থাৎ ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের কাজে তার ব্যবহার। কাজেই, সেই আমদানিতে রাশ টানলে আয়বৃদ্ধির হারে ধাক্কা লাগবে।
বলতেই পারেন, সোনা বা মণিরত্ন কেন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হবে? আপত্তিটা অমূলক নয়, কিন্তু সোনা আমদানির প্রসঙ্গটি জটিল। সোনার অন্যতম ব্যবহার সম্পত্তি হিসেবে, এবং এক ধরনের বিমা হিসেবেও। ফলে, ভারতে সোনার চাহিদা বেশ চড়া। তার আমদানিতে রাশ টানলে কালোবাজারি বাড়বে, স্মাগলিং বাড়বে। এবং, চোরাপথে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনও বাড়বে। এই বছর জুলাই-অগস্টে সোনা আমদানির পরিমাণ গত বছরের এই দুই মাসের তুলনায় ৬৫% বেড়েছে। তার ওপর সোনায় আমদানি শুল্কের পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০%। এই চড়া আমদানি শুল্কই স্মাগলিংয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। অন্য দিকে, গহনা শিল্পে সোনা অন্যতম কাঁচামাল। দীর্ঘ দিন ধরে গহনার রফতানির বাজারে মন্দার পর সম্প্রতি সেই বাজার ফের চাঙ্গা হয়েছে। এখন সোনা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে সেই রফতানি ক্ষেত্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গত চার মাসে ভারতের রফতানি ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। প্রশ্ন হল, সেই ক্ষেত্রটি কি হঠাৎ আরও চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে, যাতে আমদানির ধাক্কা সামলানো যায়? এটা বলা সহজ, কিন্তু বাস্তবে করা কঠিন। রফতানি ক্ষেত্রের সমস্যা অনেক। তার মধ্যে একটি বড় সমস্যা হল নগদের জোগানের। সেই সমস্যার সমাধান করা জরুরি। গত কয়েক মাসে ব্যাঙ্কঋণের পরিমাণ কার্যত শূন্যে এসে ঠেকেছে। তার ওপর, রফতানিকারীদের জিএসটি-র রিটার্ন পেতেও বিপুল দেরি হচ্ছে। নগদের জোগানের সমস্যাটি অতএব তীব্রতর হয়েছে। রফতানিকারীরা যাতে তাড়াতাড়ি জিএসটি রিটার্ন পেতে পারেন, জিএসটি পর্ষদের বৈঠকে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, এবং উদ্যোগও হয়েছে। কিন্তু, এই প্রসঙ্গে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ২০১৭-১৮ সালের বার্ষিক রিপোর্টের পর্যবেক্ষণটি খেয়াল করা জরুরি। রিপোর্টটি বলছে, বিশ্ববাজারে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধির পুরো সুযোগ ভারতীয় রফতানিকারীরা নিতে পারছেন না, তার কারণ হল, দেশের বাজারে নগদের জোগান কম, নথিপত্র সংক্রান্ত দীর্ঘসূত্রতা প্রবল, এবং জিএসটির রিফান্ডে দেরি। গহনা, রেডিমেড জামাকাপড়, কার্পেট বা হাতে তৈরি জিনিসের মতো শ্রমনিবিড় ক্ষেত্রের রফতানিতে এই অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলির প্রভাব সব চেয়ে মারাত্মক। টাকার পড়তি দামের ধাক্কায় অর্থনীতি যখন বেহাল, তখন এই ক্ষেত্রগুলির রফতানিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়, এবং অতি দ্রুত যাতে রফতানি বাড়ে, তেমন ব্যবস্থা করা উচিত। এই প্রসঙ্গে এটাও মনে রাখা উচিত যে রফতানি বৃদ্ধির হার ডলারের সাপেক্ষে টাকার দামের তুলনায় বেশি নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার ওপর।
এত গোলমালের মধ্যেও ভাল দিক বলতে বার বারই শোনা যায় ভারতের বিপুল বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারের কথা। ঘটনা হল, সাম্প্রতিক উথালপাথালে ভারতের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারের পরিমাণ ৮১৯.৫ মিলিয়ন ডলার কমে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের নীচে নেমে এসেছে— গত এক বছরে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারের পরিমাণ এত কম কখনও হয়নি— কিন্তু, সেই ভাণ্ডারও ভারতীয় অর্থনীতির ওপর আন্তর্জাতিক আস্থা বজায় রাখার পক্ষে যথেষ্ট। অন্তত বেশ কিছু দিনের জন্য। প্রশ্ন হল, এখন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের কী করণীয়? ২০১৬ সালের আর্থিক নীতি কাঠামো প্রকাশিত হওয়ার পর রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের একমাত্র কর্তব্য হয়েছে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ। কাজেই, টাকার দামের এই পতন দেখে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের পক্ষে হাত গুটিয়ে বসে থাকা অসম্ভব— আর কোনও কারণে না হোক, মূল্যস্ফীতির ওপর এই পতনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণেই।
টাকার এই যথেচ্ছ পতন রুখতে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে বিদেশি মুদ্রার বাজারে হস্তক্ষেপ করতেই হবে। টাকার পতন যথাসাধ্য রুখতে হবে, যাতে বাজারে আস্থা বজায় থাকে। ১৯৯৭ সালে পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ভাল সামাল দিয়েছিল। ২০০৮ সালের আন্তর্জাতিক মন্দার সময়েও টাকার দামকে তেমন পড়তে দেয়নি। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর বিমল জালানের কথা উদ্ধৃত করি— ‘‘বাজারের প্রত্যাশার বিপরীতে গিয়ে ভারতীয় মুদ্রার দাম যখন সত্যিই পড়তে আরম্ভ করল, এবং এমন একটা জায়গায় পৌঁছল যেটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অত্যন্ত কড়া হাতে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল। তখন কিন্তু ভারতের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে খুব বেশি ডলার ছিল না। এখন আমাদের অনেক ডলার আছে।’’ বিদেশি মুদ্রার বাজারে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের হস্তক্ষেপ জরুরি, কারণ টাকার পড়তি দামের সঙ্গে অর্থনীতির স্বাস্থ্য জড়ি়য়ে আছে। ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম যত কমে, কর্পোরেট সংস্থাগুলির পক্ষে আন্তর্জাতিক ঋণ শোধ করাও ততই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সুদ বাড়ে, ফলে উৎপাদনের ব্যয়ও বাড়ে। পেট্রোলিয়াম আমদানির খরচ বাড়ায় আমরা বিদেশ থেকে মূল্যবৃদ্ধিও আমদানি করে ফেলি।
আরও বড় কথা হল, টাকার দামের এই পতন যখন কিছু দিন পর পরই ঘটছে, তখন অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, চালু খাতে ঘাটতির পরিমাণ যাতে সব সময় নিয়ন্ত্রণযোগ্য সীমার মধ্যে থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি লগ্নির দৌলতে তৈরি হওয়া চালু খাতে বড় ঘাটতি সব সময়ই বিপজ্জনক— তা লগ্নির আসা-যাওয়ার ওপর অর্থনীতিকে নির্ভরশীল করে তোলে। দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লগ্নি যাতে আসে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এবং, ভারতীয় অর্থনীতি ফের বছরে আট শতাংশ হারে বাড়তে চাইছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে চাপতে থাকলে সেই বৃদ্ধির হারে পৌঁছনো অসম্ভব। অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং রফতানির বৃদ্ধির মধ্যে যাতে সাযুজ্য বজায় থাকে, তা নিশ্চিত করার কথা মাথায় রেখেই আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার দামকে ম্যানেজ করতে হবে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিন্যান্স অ্যান্ড পলিসি, দিল্লি-তে অর্থনীতির শিক্ষক; পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য। মতামত ব্যক্তিগত