ছবি: সংগৃহীত
সংবাদে প্রকাশ, জঙ্গলমহলের জন-মন বুঝতে প্রশাসনিক কর্তারা এলাকায় ঘুরে ঘুরে মানুষের কথা শুনছেন। এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে পুরুলিয়া এবং ঝাড়গ্রামের জেলা প্রশাসন। ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক লালগড়ের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে শুধু মানুষের কথা শুনেই ক্ষান্ত হননি, তাঁঁদের সঙ্গে রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে একটা স্কুলে রাত্রিযাপনও করেছেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি অনুযায়ী দলীয় নেতা-মন্ত্রীরা এই ভাবে গ্রামে গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের অভাব অভিযোগ শুনছেন। সম্পূর্ণ ভাবে ঘোষিত দলীয় কর্মসূচি এটি, এর সঙ্গে সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের কোনও যোগ নেই।
ভোটসর্বস্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে চির কাল তাদের নিজস্ব কৌশল প্রয়োগ করে জনগণ (বা ভোটার)-এর মন বোঝার পাশে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ দেখানোর প্রচেষ্টা স্বাভাবিক। স্বাধীন ভারতে সরকারের তরফ থেকেও প্রশাসনকে জনমুখী করে তোলার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। তবে কিনা, স্বয়ং জেলাশাসক গ্রামের স্কুলে রাত কাটাচ্ছেন, এ ঘটনা কিন্তু বিরল।
কিন্তু বিগত লোকসভা ভোটের ফল যে সব জায়গায় শাসক দলের বিরুদ্ধে গিয়েছে, ঠিক সেখানে এই ধরনের সরকারি উদ্যোগ একটা দ্বিধামিশ্রিত প্রশ্নের উদ্রেক করে। সরকারি প্রশাসনকে জনমুখী করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের যথার্থ গণসেবক হিসেবে তুলে ধরার এই উদ্যোগ কি যথার্থই প্রশাসনিক সদিচ্ছাজাত, না কি দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচিরই একটা বর্ধিত রূপ?
২০১৩ সালে এই রাজ্যে জনপরিষেবা অধিকার আইন বলবৎ হয়। এর উদ্দেশ্য— বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা প্রদান নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করা। কিন্তু সরকারের বহু দফতর এখনও এই আইনের আওতায় কোন কোন পরিষেবা কত দিনের মধ্যে প্রদান করা হবে, সেই বিজ্ঞপ্তি জারি করেনি। সঙ্গত কারণেই, কর্তাদের জনসংযোগ যে আসলে জনসাধারণের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার অছিলামাত্র, সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম সেই সন্দেহকে দৃঢ় করে।
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের সব জেলায় গিয়ে প্রশাসনিক সভা করার রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। এই সব সভায় রাজ্য সচিবালয়ের বরিষ্ঠ আধিকারিক ও সংশ্লিষ্ট জেলার সব স্তরের আধিকারিকরা উপস্থিত থাকেন। অন্যান্য মন্ত্রী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও এতে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু আরও তাৎপর্যপূর্ণ— প্রতিটি প্রশাসনিক সভায় গণমাধ্যমের উপস্থিতি। মুখ্যমন্ত্রী এই সব সভায় ঊর্ধ্বতন-অধস্তন নির্বিশেষে সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে যে আচরণ করে আসছেন, তা অনেক ক্ষেত্রে শালীনতাহীন ও প্রোটোকল-বিরোধী। দল ও সরকারের মধ্যবর্তী কাঙ্ক্ষিত বিভাজনটি লঙ্ঘনের বার্তা সরাসরি জনসমক্ষে উঠে আসে মিডিয়ার কল্যাণে।
ফল? প্রশাসন সম্পর্কে সমাজে এক নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী প্রকল্প স্রেফ প্রশাসনিক কর্তাদের অযোগ্যতা, উদাসীনতা ও অসততার জন্যে প্রকৃত প্রাপকদের কাছে পৌঁছচ্ছে না। এই বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে, রাজনৈতিক ক্ষমতাপুষ্ট নাগরিকরা ইচ্ছা করলে প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মীদের সঙ্গে গৃহপরিচারকের মতো আচরণ করতে পারেন। অর্থাৎ সরকারি কর্মীরাই গণশত্রু এবং স্বহস্তে এঁদের উচিত শিক্ষা দেওয়াটা আমজনতার গণতান্ত্রিক অধিকার।
তাই রাজার চাইতে পারিষদরা এখন ক্ষমতা জাহির করতে অধিকতর উদ্বুদ্ধ। সরকারি আধিকারিক থেকে সাধারণ কর্মী, চিকিৎসক, শিক্ষক, সকলেই শারীরিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। কখনও পুলিশকে ধরাশায়ী করে থানা থেকে আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কখনও গোষ্ঠীসংঘর্ষ প্রতিরোধ করতে গিয়ে পুলিশকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে, পুলিশ ও প্রশাসনের একটা বৃহদংশ ‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা’-মন্ত্রে চলছেন। রাজনৈতিক ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হচ্ছেন।
তবে এ-সবের মধ্যেও দু’এক জন মেরুদণ্ডী কর্মী নিশ্চয় আছেন, যাঁরা সৎ ভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এখনও সচেষ্ট। কিছু দিন আগে এমনই এক প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রী অনুযোগ করেছেন, পুলিশ নাকি অন্যান্য রাজনৈতিক দুষ্কৃতীর বেলায় চোখ বন্ধ রেখে শুধুমাত্র তৃণমূল কর্মীদের অকারণে হেনস্থা করছে। সরকারি প্রশাসনিক সভায় রাজ্যের সর্বাধিনায়িকা তথা পুলিশমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরে কি আর পুলিশের পক্ষে মেরুদণ্ড ঋজু রাখা সম্ভব?
এই রাজ্যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না ঘটলে চুরি-ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, এমনকি ধর্ষণের মতো নারকীয় ঘটনাতেও প্রশাসন দায় এড়িয়ে যায়। নিমতায় দেবাঞ্জন দাস হত্যাকাণ্ড, কিংবা দুই গাড়ি চালকের বচসায় প্রৌঢ় খুনের ঘটনায় পুলিশের অসক্রিয়তা এর উদাহরণ।
সরকারি প্রশাসনের পাশাপাশি সমান্তরাল রাজনৈতিক প্রশাসন বামেদের দান ঠিকই, কিন্তু সরকারি প্রশাসনকে সম্পূর্ণ ভাবে দলীয় নিয়ন্ত্রণে এনে কার্যত সেটিকে দলীয় প্রশাসনে রূপান্তরের দায় কি এই সরকার অস্বীকার করতে পারে?
গত লোকসভা নির্বাচনের পর মুখ্যমন্ত্রী সখেদে বলেছিলেন, তিনি প্রয়োজনাতিরিক্ত কাজ করে ফেলেছেন, তাই ভোটাররা তাঁর দলকে বিমুখ করেছেন। এ বার তিনি ভোটারদের মন বোঝার কাজে প্রশাসন এবং দলকে যদি একাকার করে দেন, তবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র শশী ডাক্তারের অনুকরণে জানতে ইচ্ছে করে— ভোট, ভোট, তোমার মন নাই, দিদি?