সময় সফর কি আমাদেরই আর এক সত্তার সন্ধানে?
তৃতীয় তরঙ্গ
দমদম বিমানবন্দর ১৯৮৪ সালে থেকে একটি যাত্রীবাহী বিমান ওড়ার পর রহস্যজনক ভাবে উধাও হয়ে যায়। ২০১৯-এ কালিম্পঙের কাছে এক দুর্গম এলাকায় একটি বিমান ভেঙে পড়ার পর জানা যায়, সেটিই ওই ১৯৮৪ সালের নিখোঁজ বিমান। কিন্তু দীর্ঘ ৩৫ বছর বিমানটি ছিল কোথায়? মাত্র ২ জন ছাড়া দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটির সব যাত্রী মারা যান। বাঁচেন বিমানের মহিলা পাইলট এবং এক রহস্যময় এক ব্যক্তি। গোয়েন্দা তদন্তে জানা যায়, বিমানটি সময় সফর ‘টাইম ট্রাভেল’ করে ২০১৯-এ পৌঁছয় এবং ভেঙে পড়ে।
দ্বিতীয় তরঙ্গ
পেশায় টিভি প্রযোজক কলকাতার এক যুবক। কিন্তু তার প্রযোজিত কোনও অনুষ্ঠানই টিআরপি দেয় না। ফলে কোনও চ্যানেলেই সে বেশি দিন টিকতে পারে না। বেশ কিছু চাকরি যাওয়ার পরে সে শরণ নেয় এক বৈজ্ঞানিকের। যিনি সময় সফরের উপায় আবিষ্কার করেছেন। তাঁর দাক্ষিণ্যে যুবক পৌঁছয় ১৯৮০ সালে। সেখানে তখন তোড়জোড় চলছে এক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল খোলার। সেখানে চাকরি পায় যুবকটি। প্রেমে পড়ে একটি মেয়ের। ঘনিয়ে ওঠে ঘটনার ঘনঘটা।
প্রথম তরঙ্গ
জেমস রিচার্ডস নামে এক যুবক নাকি হঠাৎই হাজির হয় অন্য এক জগতে। সেখানে তখন ১৯৭০-পরবর্তী সময়কাল। জেমস জানতে পারে, তার প্রিয় ‘দ্য বিটলস’ তখনও আছে। জন লেনন এবং জর্জ হ্যারিসন অ্যালবাম বার করেন। সেই সময়মাত্রা থেকে রিচার্ডস ‘বিটলস’-এর একটি ক্যাসেট চুরি করে ফিরে আসে এই ভুবনে। ক্যাসেটের নাম ‘এভরিডে কেমিস্ট্রি’। ২০০৯ সালে সেই অ্যালবাম বিনাপয়সায় ডাউনলোডের জন্য অন্তর্জালে ছেড়ে দেওয়া হয়। ইউটিউবেও সেই অ্যালবামের ১১টি গানই লভ্য।
অতীতকে মেরামত করতে সময় সফর: 'জেএল ৫০' ছবির দৃশ্য।
আরও পড়ুন: অন্য রাজ্য পুজো সীমিত রাখলে তাদের ‘হিন্দুবিদ্বেষী’ বলা হয় না
উল্লিখিত তিনটি তরঙ্গের তৃতীয়টি ২০২০ সালে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রিলিজ হওয়া ‘জেএল ৫০’ নামের চার পর্বের এক হিন্দি ওয়েব সিরিজের। শৈলেন্দ্র ব্যাস পরিচালিত ওই সিরিজে অভিনয় করেছেন অভয় দেওল, ঋতিকা আনন্দ, পঙ্কজ কপূর, রাজেশ শর্মা প্রমুখ। দ্বিতীয়টি ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছবি ‘অ্যাবি সেন’-এর। ছবির পরিচালক অতনু ঘোষ। অভিনয় করেছিলেন আবির চট্টোপাধ্যায়, রাইমা সেন। প্রথম তরঙ্গের কাহিনিটি ইন্টারনেটেই সহজলভ্য। সেটিকে সত্য বলে চালানোর চেষ্টা থাকলেও বিশেষজ্ঞরা জানান, ‘এভরিডে কেমিস্ট্রি’ বলে পরিচিত অ্যালবামটি আসলে একটি ‘ম্যাশ আপ’ অ্যালবাম। ‘বিটলস’ ভেঙে যাওয়ার পর লেনন, ম্যাককার্টনি, রিঙ্গো এবং হ্যারিসন যে সব সোলো অ্যালবাম বার করেছিলেন, তা থেকে কিছু গান তুলে নিয়ে দক্ষহাতে করা রিমিক্স।
টাইম ট্রাভেল ছাড়া তিনটি কাহিনির আরও একটি যোগসূত্র রয়েছে— তিনটি কাহিনিতেই পাড়ি দেওয়া হচ্ছে নিকট অতীতে। আরও লক্ষণীয়, ‘অতীত’-ই হোক বা ‘অন্য সময়মাত্রা’, সেটা প্রাক-বিশ্বায়ন দুনিয়া। টাইম ট্রাভেল নিয়ে ধ্রুপদী কল্পবিজ্ঞান কাহিনির সিংহভাগই দূর ভবিষ্যতে ভ্রমণের গল্প। অতীতে পাড়ি দিলেও কাহিনি তার কুশীলবদের নিয়ে গিয়েছে দূর অতীতে। কিন্তু উপরে বর্ণিত তিন কাহিনি সেই পথে হাঁটেনি। এই সময়ের ওয়েব সিরিজ, সিনেমা এবং পল্লবিত কাহিনি পিছু হঠেছে সাম্প্রতিক অতীতেই।
এই তিনটি কাহিনিসূত্র কি এক বিশেষ প্রবণতা, যা আমাদের প্রাক-বিশ্বায়ন পর্বে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়? এর পিছনে কি আসলে রয়েছে উত্তর-বিশ্বায়ন পর্বের ‘অস্বস্তি’গুলিকে এড়িয়ে একটা ‘কমফর্ট জোন’ খোঁজার প্রয়াস? উপরে বর্ণিত তৃতীয় তরঙ্গটি একটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, যেখানে অতীতে ফিরতে হচ্ছে বর্তমানকে বদলাতে। কাহিনির নায়ক তার আত্মপরিচয়ও খুঁজে পায় ১৯৮৪-এ ফিরে গিয়ে। দুঃসহ বর্তমানকে সহনীয় করতেই কি তার এই অতীতযাত্রা? দ্বিতীয় কাহিনিসূত্রে ধ্রুপদী মানসিকতাসম্পন্ন অ্যাবি সেন সাম্প্রতিক সময়ে টিভি প্রযোজক হিসেবে অচল। তাকে তাই চাকরি খুঁজতে হচ্ছে ১৯৮০ সালে ফিরে গিয়ে। আর প্রথম কাহিনিসূত্রটি তো সরাসরি ১৯৭০-পরবর্তী বিশ্বে ‘বিটলস’-এর টিকে থাকার মধ্য দিয়ে সেই বার্তাই দিচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়মাত্রায় ‘বিটলস’-এর মতো ‘কমফর্ট জোন’ একান্ত প্রয়োজন। সেই সময় পেরিয়ে আসা প্রজন্মকে আশ্বস্ত করতে চাওয়া যে, অতীতের মূল্যবোধ, সম্পর্কঘটিত উষ্ণতা ইত্যাদি টিকে আছে।
এই বিচিত্র সময় সফরকে কী চোখে দেখেন সম সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কল্পবিজ্ঞান লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়? তাঁর জবাব, “১৯৮০-র দশকটা কি সত্যিই খুব কমফর্টেবল? এটা ভেবে দেখা দরকার।” তা হলে কি একটা বিভ্রমের বশবর্তী হয়ে এই সময় সফর? মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “বেশিরভাগ শিল্পই আত্মজৈবনিক। প্রাক-বিশ্বায়ন স্মৃতিও আমাদের মাথার ভিতরেই রয়েছে। ডিজিটাল মেমরিতে আমরা একে পাব না। টাইম ট্রাভেলের ক্ষেত্রে খুব লক্ষণীয় কিছু বদল দেখাতে হয়। ১৯৮০-র দশকে ল্যান্ডলাইন ছিল, মানুষের জীবনে ‘অপেক্ষা’ বলে একটা ব্যাপার ছিল। ফলে আজকের সময়ের থেকে পার্থক্যটা খুব স্পষ্ট ভাবে দেখানো যায়।”
১৯৮০-র দশকটা কি আদৌ খুব আরামের ছিল? 'অ্যাবি সেন' ছবির দৃশ্য।
প্রাক বিশ্বায়ন পর্বে এ দেশে সামাজিক বৈষম্য ছিল। সমাজও হিংসা-মুক্ত ছিল না। বাঙালির জীবনে বাদুড়ঝোলা পরিবহণ, লোডশেডিং, বেকারত্ব— সবই প্রকট ভাবে ছিল। ‘অ্যাবি সেন’-এ পরিচালক সেই সব লক্ষণগুলিকে সযত্নে দেখিয়েছেন। কিন্তু তা অতিক্রম করেও এমন কিছু ছিল, যার জন্য সাম্প্রতিক থেকে পালানোর একটা আকুতি এই সব আত্মজৈবনিক কাজের মধ্যে দেখা যায়। ‘জেএল ৫০’ সিরিজটিতেও বর্তমান থেকে পিছিয়ে গিয়ে নায়ক ১৯৮৪ সালে পৌঁছে তার অতীত মেরামত করে ভবিষ্যৎকে সহনীয় করে তোলে। সমাজবিদ প্রদীপ বসুর ব্যাখ্যা, “আগের যুগটাকে বর্তমানের চাইতে ভাল ভাবার একটা প্রবণতা আমাদের মধ্যে সর্বদা রয়েছে। এই প্রবণতা আবার আধুনিকতা থেকে পালানোর প্রবণতাও হতে পারে। গ্যাজেট-শাসিত বর্তমান থেকে পালিয়ে প্রাক-বিশ্বায়ন সময়ে হাজির হওয়ার পিছনে সেটাও কাজ করে থাকতে পারে।”
সময়ের আনাচে কানাচে কোথাও টিকে আছে 'বিটলস'। আজও নাকি অ্যালবাম বের করেন তাঁরা!
আরও পড়ুন: নারী যখন সব ক্ষমতার আধার
সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যের জনপ্রিয় আঙিনার বড় প্রবণতা হল প্রাক-বিশ্বায়ন পটভূমিকার অবতারণা। এমনকি, রহস্য কাহিনিগুলিতেও তেমন টেক-স্যাভি নয় এমন গোয়েন্দাদের অবতারণা। উত্তর ইউরোপে দেশগুলির রহস্যোপন্যাস এখন সারা পৃথিবীতেই আদৃত। সেই সব লেখাতেও এই প্রবণতা জ্বলজ্বল করছে। আধুনিক শহরের অন্ত্রের ভিতরে লুকিয়ে থাকা এক অনাধুনিক ধূসরতাকে আমরা খুঁড়ে বের করতে ভালবাসছি। উপরে বর্ণিত তিনটি কাহিনিসূত্র স্পষ্ট দেখিয়েছে সেই ম্যাজিককে। এই কাহিনিগুলির রচয়িতারা হয়তো আত্মজৈবনিকতার তাড়নাতেই নির্মাণ করেছেন এগুলিকে। কিন্তু সেই ‘আত্ম’টি দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের ‘আত্ম’-র কোথাও টান দিচ্ছে।