ভঙ্গিমা: জঙ্গলমহলে বাঘের মৃত্যুর পরে। নিজস্ব চিত্র
খেলা দেখাত উইলি। বন্দি এক কিলার হোয়েল। ডলফিন পরিবারেরই এক প্রাণী। ঝাঁক বেঁধে থাকতেই পছন্দ করে এই প্রাণীটি। কিন্তু হঠাৎই ধরা পড়ে যায় শিকারিদের জালে। বন্দি অবস্থায় খেলা দেখাতে দেখাতে সে ক্লান্ত। এক সময়ে তার বন্ধুত্ব হয় জেসি নামে একটি ছেলের সঙ্গে। জেসি বুঝতে পেরেছিল বন্দি উইলির কষ্ট। সে এবং তার বন্ধুরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে উইলিকে সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। এবং সফল হয়।
১৯৯৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল হলিউডের সিনেমাটি। ‘ফ্রি উইলি’। এক প্রাণীর মুক্তির জন্য ছোট একটি ছেলের লড়াই। সাড়া জাগিয়েছিল জেসি আর উইলির মুক্তির লড়াই। ২০১১ সালের ছবি ‘চিল্লার পার্টি’। বলিউডের। এক আবাসনের বাচ্চাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল পথ কুকুরের এক বাচ্চার সঙ্গে। কিন্তু তার আবাসনে থাকাটা না-পসন্দ অনেকের। ফলে শুরু বাচ্চাদের ভালবাসার সঙ্গে বড়দের অপছন্দের লড়াই। শেষে জেতে বাচ্চাদের লড়াই।
ভালবাসার উদাহরণ আছে। যেগুলোকে দৃষ্টান্ত হিসেবেই খাড়া করা যায়। কিন্তু বাস্তবে ঘটে তার উল্টো। এলাকায় হাতি ঢুকে পড়েছে। কিছু লোক হইহই করে পিছনে পড়ে গেল হাতির দলের। যতটা সম্ভব কাছে গিয়ে ছবি তোলা, নিজস্বী নেওয়ার চেষ্টা। যতরকম ভাবে সম্ভব উত্ত্যক্ত করা হয় প্রাণীটিকে। পূর্ব মেদিনীপুরের কয়েকটি এলাকায় মাঝে মাঝে বসত এলাকায় ঢুকে পড়ে বাঘরোল। কোনও ভাবে মুরগির খাঁচায় বা মাছের জালে বন্দি হলে তার আর নিস্তার নেই। প্রাণ নিয়ে ফেরার ঘটনা কমই ঘটে। গত সপ্তাহে এই জেলারই কাঁথি মহকুমার ভূপতিনগর এলাকার এক খালে ঢুকে পড়েছিল একটি ডলফিন। না সেই ডলফিনের জন্য নেতুড়িয়ার খালের পাড়ে কোনও জেসি দাঁড়িয়েছিল না। তামাশা দেখতে জড়ো হওয়া বহু মানুষ ছিল। যাদের ক্রমাগত চিৎকারে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল ডলফিনটি। বন দফতর বাঁচাতে পারেনি আটকে পড়া প্রাণীটিকে। তাকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি সমুদ্রে।
ভূপতিনগরে ডলফিনের মৃত্যুর পরে যেন তারই পুনরাবৃত্তি। নিজস্ব চিত্র
কেন এরকম করে মানুষ? এই সময়ে আসলে কী করা উচিত? কী বলছেন নবীন প্রজন্ম? মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর কলেজের অঙ্ক অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র কল্লোল জানা। তিনি পরিষ্কার জানালেন, হাতি, বাঘরোল বা ডলফিন যে প্রাণীই দেখা যাক না, প্রথম কাজ হওয়া উচিত বনদফতরকে খবর দেওয়া। হাতির ক্ষেত্রে কাছাকাছির হুলাপার্টিকে। লোকজন জমা হয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হলে তাঁদের দূরে সরানোর ব্যবস্থা করা উচিত। কল্লোলের কথায়, ‘‘বন্যপ্রাণীদের মেরে ফেলাটা ঠিক নয়। বরং ভাবা উচিত, পরবর্তীকালে কী ভাবে তাদের বাঁচানো যাবে।’’ একই কথা বললেন, এই কলেজেরই বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুমিতা গিরি। সুমিতার কথায়, ‘‘বাঘরোল লুপ্তপ্রায় প্রাণী। বাঘরোলকে মেরে ফেললে বাস্তুতন্ত্রে মহাসঙ্কট দেখা দিতে পারে। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সচেতন করব। পাশাপাশি বেড়াল আঘাত পেলে তারও চিকিৎসা করব।’’ সুমিতা মনে করেন, ‘‘মৃত প্রাণীর সঙ্গে নিজস্বী তোলা একেবারেই অপসংস্কৃতির পরিচয় দেওয়া। এ ধরনের ছবি তোলা মানে নিজের শিক্ষাকে অপমান করা।’’
যে এলাকায় ডলফিনটি ঢুকে পড়েছিল সেই এলাকার স্কুল চম্পাইনগর হাইস্কুল। স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র প্রসেনজিৎ ঘোড়াই বলল, ‘‘ওই সময়ে খালের পাড় থেকে লোকেদের দ্রুত সরে যাওয়ার জন্য সচেতন করব। বাঘরোলের মতো প্রাণীকে আক্রমণের আগে উত্তেজিত লোকেদের ক্রোধ প্রশমন করা দরকার।’’ স্নেহা বন্দ্যোপাধ্যায় ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, কোনও বন্যপ্রাণকে কিছুতেই উত্ত্যক্ত করা উচিত নয়। তাদের স্বাভাবিক বিচরণ করতে দেওয়া উচিত। কোনও কোনও মানুষ এটা করে থাকেন।
স্বরূপ সেনের বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের গুড়গুড়িপালে। তিনি কে ডি কলেজের বাংলা অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। তাঁর এলাকায় মাঝে মাঝেই হাতি আসে। ফলে সমস্যা নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা রয়েছে। স্বরূপ বললেন, ‘‘আমাদের ধারণা আছে। এই সময়ে বন দফতরকে সাহায্য করা ছাড়া উপায় নেই। হাতির সঙ্গে খেলতে গেলে মৃত্যু অনিবার্য।’’ তবুও তো লোকে হাতি দেখলে উত্ত্যক্ত করেন? এ বিষয়ে স্বরূপের বক্তব্য, ‘‘বাইরে থেকেও লোক আসে। হাতিকে উত্ত্যক্ত করলেই কিন্তু ক্ষতি করে। হাতি কখনই ছুটে এসে তাড়া করবে না।’’ তাঁদের এলাকায় বন্যপ্রাণ নিয়ে সচেতনতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরূপ। একবার ময়াল সাপ বেরিয়েছিল। কিন্তু এলাকাবাসী কেউ ক্ষতি করেননি। বরং বন দফতরকে খবর দিয়ে উদ্ধার করিয়েছিলেন। গোপীবল্লভপুরের সুবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৃন্ময় বেরা। তাঁর এলাকাতেও একবার ময়াল সাপ বেরিয়েছিল। কিন্তু সেটিকেই বন দফতরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। তাঁর কথায়, ‘‘স্থানীয় মানুষকে সচেতন হতে হবে। প্রথম কাজই হবে হাতির পিছনে না ছোটা। বন্যপ্রাণীকে বিরক্ত না করা।’’
মানুষ কেন বন্যপ্রাণীকে মেরে ফেলে? এ বিষয়ে তৃন্ময়ের মত, ‘‘আতঙ্কিত হয়ে মেরে দেয়। মনে করে তাদের ক্ষতি হয়ে যাবে।’’
তখন রাজরাজড়ার আমল। শখের শিকারি প্রচুর। তাঁরা সব বাঘ শিকার করে, হাতি মেরে মৃত পশুর গায়ে পা তুলে ‘পোজ’ দিতেন। এখনও ‘পোজ’ দেওয়ার স্বভাব মানুষের যায়নি। মৃত পশুকে নিয়ে ছবি তোলার উল্লাস যতই অনুভূতিসম্পন্ন মানুষকে অধোবদন করুক, কিছু মানুষের উল্লাসের কাছে তা কিছুই নয়। গত বছর জঙ্গলমহলে বাঘের মৃত্যুর সময়ে দেখা গিয়েছিল। এবার মৃত ডলফিন নিয়েও সেই প্রবণতা। স্নেহা, তৃন্ময়, স্বরূপদের মত নানারকম। কেউ বললেন, ছবি তোলাটা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। বাহাদুরি কিছুই নেই। স্মৃতি হিসেবে ছবি রেখে দিতে চায়। কারও মত ফেসবুকে দেওয়ার জন্য ছবি তোলেন কেউ কেউ।
রাগি স্বর শোনা যায় কারও কারও গলায়। তাঁরা বলেন, ‘‘ভিতু মনে হয় ওই লোকগুলোকে। এটা দেখানেপনা ছাড়া কিছুই নয়।’’