কোভিড সঙ্কট থেকে ভারতীয় অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য অর্থমন্ত্রী শ্রীমতী নির্মলা সীতারামন পাঁচ দিন ধরে যে পদক্ষেপগুলির কথা ঘোষণা করলেন তার মধ্যে বেশ কিছু বাজারমুখী সংস্কার রয়েছে। সংস্কারগুলি বিতর্কিত। কাজেই সে সব নিয়ে বিরোধীরা যে নানা রকম অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রশ্ন তুলবেন, এটা আশ্চর্য নয়। কিন্তু যদি ধরেও নিই, দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে সংস্কারগুলির প্রয়োজন আছে, তা হলেও সংস্কারের সময় নির্বাচন নিয়ে একটা বড় জিজ্ঞাসা থেকে যায়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই পদক্ষেপগুলি কেন ঠিক এখনই, এই সঙ্কটের মুহূর্তে, ঘোষণা করা হল? কেন এই ঘোষণা আগে করা হয়নি কিংবা কেন তা ভবিষ্যতের জন্যেও তুলে রাখা হচ্ছে না? সংস্কারের সময় নির্বাচন আরও বিভ্রান্তিকর এই কারণে যে, সংস্কারগুলি বাস্তবায়িত হলে বেশ কিছু মানুষের চাকরি ও রুটি-রুজি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। কোভিড সঙ্কটের কারণে যখন ইতিমধ্যেই ব্যাপক ভাবে চাকরির অনিশ্চয়তা চরমে উঠেছে, তখন এই অনিশ্চয়তাকে আরও বাড়ানোর কী প্রয়োজন ছিল?
সংস্কারগুলি সবই বেসরকারিকরণের পদক্ষেপ। যে ক্ষেত্রগুলি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল, ঘোষণা করা হয়েছে, অচিরেই সেগুলির নিয়ন্ত্রণ বেসরকারি পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। বেসরকারিকরণের জন্য তিনটি ক্ষেত্রের কথা আলাদা করে বলা হয়েছে— কয়লাখনি, বিমানবন্দর এবং প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্রশস্ত্রের উৎপাদন। কিন্তু বেসরকারিকরণ এই তিনটি ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এমন মোটেই নয়। বস্তুত, ঘোষণা করা হয়েছে, সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় সমস্ত সংস্থাগুলিতেই বেসরকারি পুঁজি ঢুকবে। এতটাই ঢুকবে যে সংস্থার নিয়ন্ত্রণ বেসরকারি পুঁজিপতিদের হাতে চলে যাবে। এর মধ্যে বড়জোর তিন-চারটে ক্ষেত্রকে ব্যতিক্রমী ধরে নিয়ে আপাতত তাদের বেসরকারিকরণের বাইরে রাখা হতে পারে। এর মানে হল, সরকারি সংস্থাগুলিতে সরকারের যে অংশ বা শেয়ার রয়েছে সেগুলি দেশি-বিদেশি বেসরকারি পুঁজিপতিদের বিক্রি করে দেওয়া হবে।
কিন্তু জাতীয় সম্পদ বিক্রি করার এটাই কি শ্রেষ্ঠ সময়? সরকারি সংস্থায় সরকারের যে অংশ আছে সেগুলির মালিক যৌথ ভাবে দেশের সমস্ত মানুষ। এই সম্পদ ভাল দামে বিক্রি করা গেলে সারা দেশ উপকৃত হবে, কম দামে বিক্রি হয়ে গেলে সারা দেশের ক্ষতি। আশঙ্কা, এই সঙ্কটের সময়ে, যখন পৃথিবী জুড়ে অর্থনীতির কর্মকাণ্ড থেমে গিয়েছে, জগৎব্যাপী মন্দা অবশ্যম্ভাবী, তখন দেশের সম্পদ বিক্রি করে ঠিক দাম পাওয়ার সম্ভাবনা নিতান্ত ক্ষীণ।
সরকারি সংস্থার যাঁরা সম্ভাব্য ক্রেতা, তাঁরা নিজেরাই এখন মন্দাক্রান্ত, নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠিত। এই অবস্থায় সরকারি সংস্থাটি কিনে সেটিকে কতটা বা কত তাড়াতাড়ি দাঁড় করানো যাবে তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ থাকাটাই স্বাভাবিক। মন্দার ছায়া যত ঘন হবে, তত এই সন্দেহ বাড়বে, এবং ততই কমবে সম্ভাব্য ক্রেতার সংখ্যা। ক্রেতার সংখ্যা কমতে কমতে শেষে হাতেগোনা দু’একজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। শুধু দু’একজন ক্রেতা রয়ে যাবেন যাঁদের আর্থিক ক্ষমতা অপরিসীম, যাঁরা একটা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা কিনে নিয়ে মন্দা কেটে যাওয়া অবধি সেটিকে ফেলে রাখার ক্ষমতা রাখে।
এর তাৎপর্য দু’টি। এক, ক্রেতার সংখ্যা অল্প হয়ে গেলে সরকারি সম্পদের মূল্য ক্রেতারাই নির্ধারণ করবেন, এবং বলাই বাহুল্য খুব বেশি দাম তাঁরা দিতে চাইবেন না। এমনিতেই মন্দার বাজারে সরকারি সংস্থার দাম খুব বেশি ওঠার কথা নয়, বিশেষ করে যদি কেনার পর সংস্থাটিকে বেশ কিছু দিন তার পুরো সামর্থ্য অনুযায়ী চালানো না যায়, তার ওপর ক্রেতার সংখ্যা অল্প হওয়ার ফলে দাম আরও পড়ে যাবে। সব মিলিয়ে এই মন্দার বাজারে সরকারি সংস্থাগুলি বিক্রি করলে সেগুলি জলের দরে বিক্রি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। দ্বিতীয়ত, ক্রেতা যদি সংস্থাটি কেনার পর সেটিকে আপাতত অকেজো করে ফেলে রাখেন তা হলে কর্মসংস্থানও তৈরি হবে না, যে কর্মসংস্থান তৈরির প্রয়োজনীয়তা এই সময়ে সব থেকে বেশি। অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ সময় তো নয়ই, সরকারি সম্পদ বিক্রি করার এটা নিকৃষ্ট সময়। তা হলে বেসরকারিকরণের ঘোষণাটা ঠিক এই সময় করা হল কেন?
অর্থমন্ত্রীর হয়ে কেউ বলতে পারেন, এই সঙ্কটের সময় সরকারের খরচ হঠাৎ বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে। তাই সম্পদ বিক্রি করা ছাড়া সরকারের আর কোনও উপায় নেই। আবার অন্য কেউ বলতে পারেন, তালাবন্দি-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির একটা দ্রুত পুনরুত্থান দরকার। আর এই পুনরুত্থানের কাজটা বেসরকারি উদ্যোগপতিরা যতটা ভাল পারবেন, সরকার ততটা পারবে না। তাই আগে থেকেই বেসরকারি উদ্যোগপতিদের বিকাশের জন্যে একটা পরিবেশ তৈরি করে রাখা হচ্ছে। একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে দুটি যুক্তিই অসার।
সরকারের খরচ বেড়েছে এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেই খরচ মেটানোর জন্যে জাতীয় সম্পদ জলের দরে বিক্রি করে দিতে হবে। খরচ মেটানোর একাধিক রাস্তা আছে। এই সঙ্কটে যে কেন্দ্রীয় সরকার কৃষককে, ক্ষুদ্র শিল্পপতিদের, এমনকি রাজ্যগুলিকেও বেশি করে ঋণ নিতে উৎসাহ দিচ্ছে, তারা নিজেরাই তো তাদের জাতীয় ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে বাড়তি খরচ খানিকটা সামাল দিতে পারে। তা ছাড়া অতি-ধনীদের ওপর আরও বর্ধিত হারে কর বসানোর বিকল্পও তো ছিল। কিন্তু সরকার সে সব বিকল্প রাস্তায় হাঁটল না।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের ভারটা বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তাটা হাস্যকর। ধরা যাক, অতি ধনী কোনও শিল্পপতি আমাদের কয়লাখনিগুলি কিনে নিলেন। কিন্তু পৃথিবী জুড়ে যদি মন্দা চলে, যদি বিদ্যুৎ বা কয়লার চাহিদা না বাড়ে তা হলেও শুধুমাত্র অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটানোর জন্য লোকসান দিয়েও সেই শিল্পপতি বর্ধিত হারে উৎপাদন করে যাবেন, এমনটাই কি অর্থমন্ত্রী আশা করছেন? সংস্কার ঘোষণার সময় নির্বাচনের রহস্যটা রয়েই গেল।
যাঁরা ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে বিশ্বাস করেন তাঁরা বলবেন, আসলে পছন্দের দু’একজন অতি-ধনী শিল্পপতিকে জলের দরে কয়লাখনি, বিমানবন্দর, অস্ত্রশস্ত্রের কারখানা ইত্যাদি জাতীয় সম্পদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য ঠিক সেই সময় এইগুলিকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হল, যখন তাদের দাম স্বাভাবিক ভাবে তলানিতে। আমরা এই তত্ত্বকে প্রমাণ কিংবা অপ্রমাণ কোনওটাই করতে পারব না, যদিও সম্ভাবনাটাকে এক কথায় উড়িয়েও দেওয়া যায় না। একটা কথা অবশ্য জোর দিয়ে বলা যায়। এই সঙ্কটের মুহূর্তে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ঘটানোর জন্য আরও বেশি পরিমাণে সরাসরি সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন ছিল। সরকার সেই দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে যে এই দুঃসময়ে বেসরকারি খেলোয়াড়দের হাতে অর্থনীতির ভাগ্যটা ছেড়ে দিচ্ছে, এটা দুর্ভাগ্যজনক।
বস্তুত, যেটা করা উচিত নয় সেটা যেমন সরকার করছে, তেমনই যেটা করা উচিত সেটা করছে না। সবার আগে সরকারের উচিত ছিল সাধারণ মানুষ, তালাবন্দির কারণে দু’মাস যাঁদের আয় বন্ধ, তাঁদের হাতে সরাসরি কিছু অর্থ পৌঁছে দেওয়া। এতে শুধু যে এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার রসদ বাড়ত তাই নয়, তালাবন্দির পর উৎপাদন শুরু হলে সেই উৎপাদনের জন্য একটা চাহিদাও তৈরি হত। সরকার সে পথে না হেঁটে ছোট-বড়-মাঝারি উদ্যোগপতিদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু উদ্যোগপতিরা যদি দেখেন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নেই তাই জিনিসপত্রের চাহিদাও নেই তা হলে তাঁরা কেন ঋণ নিয়ে উৎপাদন করবেন?
আর একটা বড় খামতি বেসরকারি বিনিয়োগ। এই অনিশ্চিত সময়ে কে আর সাহস করে বিনিয়োগ করবে? কিন্তু বিনিয়োগ না করলে কর্মসংস্থান হবে না, চাহিদা বাড়বে না। এই খামতিটা সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া যেত। গত বছর স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী পরিকাঠামোয় যে বিপুল বিনিয়োগের কথা বলেছিলেন, যার প্রতিধ্বনি অর্থমন্ত্রীর এ বছরের বাজেট বক্তৃতাতেও শোনা গিয়েছিল, এখনই তো সেই বিনিয়োগ করার সময়। তার কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি না কেন? পরিকাঠামোয় সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে এক দিকে যেমন সরাসরি কর্মসংস্থান বাড়ত, তেমনই অন্য দিকে বেসরকারি বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা বাড়ত, ফলে হয়তো বেসরকারি বিনিয়োগও কিছুটা বাড়ত। যে বেসরকারি শিল্পপতিদের অর্থমন্ত্রী এতটা প্রাধান্য দিতে চেয়েছেন, সঙ্কটমোচনের ঘোষিত পদক্ষেপগুলোতে তাঁরাও যে খুশি হননি তার প্রমাণ, শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে।
অর্থনীতি বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা