নাগরিক পঞ্জি তৈরির কাজ চলছে। ফাইল ছবি
অসমের নাগরিকপঞ্জি তীব্র বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই সমস্যার যে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে তা আমরা অনেকেই জানি না। সেই ইতিহাসের পাতা থেকে বিক্ষিপ্ত ভাবে তুলে আনা কিছু ঘটনার দিকে চোখ রাখলে সমস্যাটির সূত্রটি পরিষ্কার হয়।
প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন, এখন কাশ্মীরের পরেই শতাংশের বিচারে সব থেকে বেশি সংখ্যালঘুর বাস অসমে। এটা হঠাৎ হয়নি। শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। ‘লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি অব অসম প্রভিন্স’-এ তিন বার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মুসলিম লিগের সৈয়দ মহম্মদ সাদুল্লা (১৯৩৭-’৪৬)। বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, অসমে বাঙালি সংখ্যালঘুদের সংখ্যা বাড়ার পিছনে রয়েছে সাদুল্লার কিছু নীতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ‘গ্রো মোর ফুড’ বা বেশি খাদ্য ফলাও বলে তিনি একটি অভিযান শুরু করেন। এই অভিযানে অসমের তৎকালীন সরকার ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় এক লক্ষ বিঘা জমি পূর্ব বাংলা থেকে আসা, প্রধানত সংখ্যালঘুদের দেওয়া হয়েছিল। এবং তাঁদের থাকার ব্যবস্থাও করা হয়। কেন এমন হয়েছিল? বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, সৈয়দ মহম্মদ সাদুল্লার মূল লক্ষ্য ছিল ‘ক্যাবিনেট মিশন’-এর ‘গ্রুপিং’ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা। যাতে অসমকে বেঙ্গল প্রভিন্স (তৃতীয় গ্রুপ) এর সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া যায়। এমন হলে অসম ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনও সীমারেখা থাকত না। ফলে, বাংলাদেশ থেকে অবাধে অসমে চলে আসা সম্ভব হত। চন্দ্রনাথ শর্মা (অসম কংগ্রেস অন্যতম স্থপতি), অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি (অসম সংগ্রামক সিমি, এএসএস এবং পরে অসম জাতি ও মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা)— সবাই এই গ্রুপিংয়ের বিরোধিতা করেন। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ বন্ধ না হলে অসমের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তাঁরা সফল হননি। ১৬ মে ১৯৪৬ সালে গাঁধীর সহযোগিতায় গোপীনাথ বরদলৈই এই পরিকল্পনাকে রোধ করতে সক্ষম হন।
১৯৫০ সালে ভারতীয় আইন সভা অভিবাসন আইন (অসম থেকে বহিষ্কার) তৈরি করে এতে হিন্দু শরণার্থী এবং মুসলমান শরণার্থীদের চিহ্নিত করার কথা বলা হয়। কিন্তু আবার রাজনৈতিক কারণে ১৯৫৭ সালে এই আইনে বড় ছাড় দেওয়া হল। ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার ‘রিভার্সন অব ইমিগ্রান্ট ফ্রম পাকিস্তান’ (আরআইপি) করলেন বটে তবে পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে এটা কার্যকর হয়নি। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, এক বিপুল ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করে নিজেদের নির্বাচনী স্বার্থ বজায় রাখাই ছিল সব রাজনৈতিক দলগুলির লক্ষ্য।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পরে ১৯৭২ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি হল। তাতে মুজিব জানিয়ে দিলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে যাঁরা ভারতে গিয়েছেন তাঁদের কোনও দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার নেবেন না। এ দিকে ‘অল আসামিজ় স্টুডেন্ট ইউনিয়ন’ (আসু) এবং এএজিএসপি বিভিন্ন সময় ইন্দিরা গাঁধী এবং মোরারজি দেশাইয়ের কাছে বাংলাদেশ থেকে মানুষদের নাম নির্বাচনী তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য আবেদন করতে থাকেন। তৎকালীন ভারতের চিফ ইলেকশন কমিশনার ১৯৭৭ সালকে নির্ধারণের সাল হিসেবে গ্রহণ করতে বললেন। কিন্তু আবেদনকারীরা তা মানলেন না। ১৯৭৯ সালে ১২ থেকে ১৭ নভেম্বরের মধ্যে এর জন্য বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে প্রায় ৩০ লক্ষ লোক গ্রেফতার হলেন। প্রতিবাদে আদালতে চার লক্ষ মামলা হল। গোলমাল চলতে থাকায় ১২ ডিসেম্বর ১৯৭৯ অসমে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হল। ১৯৮০ সালে এক মাত্র কাছাড় ছাড়া সর্বত্র আসু সাধারণ নির্বাচন বয়কট করল। তারা ধুলিয়াজান, নুনমাটি, বারাউনির মতো জায়গায় তেল উৎপাদন বন্ধ করার দাবি জানাল।
১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ছিল অসমের ইতিহাস, রক্তক্ষয়ের ইতিহাস। এর মাঝে ১৯৮৩ সালে ইন্দিরা গাঁধীর সরকার ইল্লিগাল মাইগ্রেন্টস (ডিটারমাইন্ড বাই ট্রাইবুনাল), (আইএমডিটি অ্যাক্ট) আইনটি তৈরি করেন। অসমের এই টালমাটাল সময়ে সংখ্যালঘুদের হেনস্থার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য শুধু অসমের ক্ষেত্রেই এই আইনটি তৈরি করা হল। বাকি রাজ্যে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে ‘ফরেনার্স অ্যাক্ট, ১৯৪৬’, ব্যবহার করতে বলা হল। অনেক রক্তক্ষয়ের পরে ১৫ অগস্ট ১৯৮৫ সালে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হল। আসু নাগরিক পঞ্জি চাইছিল ১৯৫২ সাল থেকে আর সরকার চাইছিল ১৯৭১ থেকে। শেষ ঠিক হল, পয়লা জানুয়ারি ১৯৬১ কে ভিত্তিবর্ষ ধরা হবে। ১৯৯২ সালে জুলাইয়ে গুয়াহাটিতে প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও জানালেন, অসমের বহিরাগত সমস্যা একটি গভীর চিন্তার কারণ এবং ‘আইএমডিটি অ্যাক্ট’ সংশোধন করা হবে। কিন্তু ১৯৯৪ সালে সেই কংগ্রেসেরই মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর সাইকিয়া জানালেন, অসমে কোনও বহিরাগত নেই।
অক্টোবর ১৯৯৬-এ ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া জানালেন, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ৩.৭৫ লক্ষ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী অসমে আছেন। তাই ‘আইএমডিটি অ্যাক্ট’ অবিলম্বে সংশোধন করা হবে। কিন্তু পরে দুই সহযোগী দল সিপিএম এবং কংগ্রেসের চাপে তিনি পিছু হটতে বাধ্য হন বলে অভিযোগ। এর পিছনে আবার ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ রাজনীতে রয়েছে বলে বিরোধী দলগুলি অভিযোগ করে। রাজনীতির অঙ্গনে সমস্যার সমাধান না হওয়ায় বিষয়টি আদালতে গড়ায়। অবশেষে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ‘আইএমডিটি অ্যাক্ট’ বাতিল হয় (সর্বদানন্দ সোনোয়াল ভার্সেস গভর্মেন্ট অব ইন্ডিয়া)। তার পরের ইতিহাস তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
প্রাক্তন অধ্যক্ষ, বিসি কলেজ, আসানসোল