ভ্রম সংশোধনের সংস্কৃতিটির একটু বিশেষত্ব রহিয়াছে, সকলের মধ্যে এই সংস্কৃতি থাকে না। আবার কেহ কেহ আছেন, যাঁহারা এই সংস্কৃতিটি আত্মরক্ষার্থে রপ্ত করেন, ভুল করিবার সময় প্রবল বীরত্ব দেখান, আবার ভুল স্বীকার করিবার সময়ও বীরত্বের কমতি রাখেন না। অর্থাৎ তাঁহাদের প্রধান উদ্দেশ্য নিজেদের বীরত্ব ও মহত্ত্ব প্রচার করা। বামফ্রন্টের নেতাজি-ভ্রমের সংশোধন ইহার সম্যক উদাহরণ। সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসাবে যে নেতা অন্তত ছয় দশক ধরিয়া প্রচারিত ও বিজ্ঞাপিত হইয়াছেন, একবিংশ শতকের গোড়ায় প্রাক্তন বাম মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বদান্যতায় তিনি অবশেষে জাতীয়তাবাদী আখ্যা লাভ করিলেন, এবং তাহার চৌদ্দো বৎসর পর, অতি সম্প্রতি, তাঁহার জন্মদিবসটিও দেশপ্রেম দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত হইল। পথের পার্থক্য সত্ত্বেও ব্রিটিশবিরোধিতার ক্ষেত্রে যে সুভাষের জেদ ও প্রত্যয়কে গাঁধী অপরিসীম শ্রদ্ধা করিতেন, তাঁহার দেশপ্রেম খুঁজিয়া বাহির করিতে যে বামফ্রন্ট নেতাদের কয়েক দশক লাগিয়া গেল, ইহা অবশ্যই কোনও দৃষ্টিক্ষীণতা বা সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচয় নয়! বিবেচনা বস্তুটি অত্যন্ত গুরুতর, কখনও কখনও কাহারও অবদান বিবেচনার মাধ্যমে বিচার করিতে শতাব্দীও ঘুরিয়া যাইতে পারে। আসল কথা, সূক্ষ্ম বিবেচনা শক্তির মাধ্যমে দিব্যজ্ঞান লাভ। বাম নেতারা শেষ পর্যন্ত সেই জ্ঞান পাইয়াছেন।
তোজোর কুকুর এবং কুইসলিং নেতাপ্রবরকে যে তাঁহারা গত শতাব্দীতে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী বলিতে পারেন নাই, তাহার কারণ কমিউনিস্টরা যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে ব্রিটিশকে সমর্থনদানের আহ্বান জানাইতেছিলেন, তখন সুভাষ বসু সে আহ্বানে কান দেন নাই। অর্থাৎ ব্রিটিশকে যাঁহারা সমর্থন দিতে চাহিতেছিলেন, এমনকী ভারতের মাটিতে ফুঁসিয়া ওঠা অগস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষিতেও ব্রিটিশের বিরুদ্ধতা করিতে রাজি হইতেছিলেন না, তাঁহারাই না কি সাম্রাজ্যবাদের শত্রু, আর যে নেতা যেন তেন প্রকারেণ ব্রিটিশ শক্তির মূলে আঘাত হানিতে চাহিতেছেন, তিনিই না কি সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক! বাম মহল হইতে গত দশ-বারো বৎসরে সুভাষের বিষয়ে ভ্রম স্বীকৃত হইলেও এই যুক্তিটির মধ্যে যে ভয়ঙ্কর গোলযোগ, তাহা যথেষ্ট পরিমাণে স্বীকৃত হইয়াছে কি না, সে কথা শোনা যায় নাই। পুরাতন কাসুন্দি খানিক না টানিয়া উপায় নাই, কেননা অবস্থানের ভ্রম স্বীকার ও যুক্তির ভ্রম স্বীকারের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য থাকিবার কথা, এবং অতীতের ন্যায় বর্তমানেও সাম্রাজ্যবাদ ও তাহার বিরোধিতা বিষয়ে বামপন্থীদের ধারণা অস্পষ্টই থাকিয়া গিয়াছে।
যুক্তির ভ্রম মানিবার অভ্যাস থাকিলে ‘দেশপ্রেম’ লইয়াও বাম নেতাদের কিছু অস্বস্তি থাকিবার কথা ছিল। তত্ত্বগত ভাবে ও ব্যবহারিক ভাবে দেশপ্রেম বস্তুটি যে কত অসার ও অপ্রাসঙ্গিক, তাঁহারাই শিখাইবার চেষ্টা করিয়া আসিয়াছেন। এত দিন পর ঘটা করিয়া দেশপ্রেম দিবস পালনের উদ্যোগের পিছনে কেহ সাম্প্রতিক রাজনীতির চাপ দেখিতেই পারেন। যুক্তির স্পষ্টতা একটি গুণ। কখনও সেই স্পষ্টতা হারাইয়া ফেলিলে তাহা স্বীকার করিয়া আত্মসমালোচনার পথে তাহা ফিরাইবার চেষ্টাও একটি গুণ। সংশয় হয়, বাম মতাদর্শবাদীদের মধ্যে এই গুণের সাধারণ উপস্থিতি কম। অন্তত সহজে দৃষ্টিগোচর হইবার মতো নয়!