ফাইল চিত্র
আটাশ বৎসর আগে ভারতের হিন্দি হৃদয়প্রদেশে যে ইতিহাস-পর্বের সূচনা হইয়াছিল, আজ তাহার অবসান হইতে চলিয়াছে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করিয়াছিল উন্মত্ত জনতা: আজ সেই ভগ্নভূমিতে— দেশের উচ্চতম আদালতের অনুমতিক্রমে— দেশের প্রধানমন্ত্রী রামমন্দির নির্মাণের সূচনা করিবেন। এই ধ্বংস বা নির্মাণ, কোনওটিই আকস্মিক ঘটনা নহে, ইহাদের পিছনে আছে এক অতি-সংহত রাজনৈতিক ভাবাদর্শ। এই ভাবাদর্শ দীর্ঘ সময় ধরিয়া এক অন্য ভারত-ভাবনার সহিত সংঘাতে ব্যাপৃত থাকিয়াছে— যে ভারত-ভাবনা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়াছে, বিজয়মুহূর্তে স্বাধীন দেশের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছে, এবং সাম্প্রতিক অতীত পর্যন্ত দেশের মানুষের দিগ্দর্শন হিসাবে প্রজ্বলিত থাকিয়াছে। আজ রামমন্দিরে শিলান্যাসের সঙ্গে সঙ্গে, সেই এত কালের উদ্যাপিত, বহুগৌরবে সম্মানিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারত-ভাবনাটি এক অর্থে পরাভূত হইবে। নিজের ক্রমবিলীয়মান জায়গা ছাড়িয়া দিবে চির-প্রতিস্পর্ধী হিন্দুত্ববাদী ভারতের ভাবাদর্শকে। আজ তাই পর্বান্তরের দিন। আজ এক পক্ষের গগনচুম্বী হর্ষোল্লাস, আর এক পক্ষের অতলান্ত বিষাদের দিন। বর্তমান শাসক দলও এই পর্বান্তরের গুরুত্ব সম্যক ভাবে জানেন। আর সেই জন্যই তাঁহারা বাছিয়া লইয়াছেন সেই তারিখটিকেই, যে তারিখে গত বৎসর কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপ করিয়া ভারতীয় সংবিধান-ব্যবস্থার ঐতিহাসিক সংশোধন হইয়াছিল। সে দিনও হিন্দুত্ববাদী ভারতের বিজয়-দণ্ড প্রোথিত হইয়াছিল। আজও সেই হিন্দুত্ববাদী ভারতেরই আর এক বিজয়-কেতন উড়িবে।
অযোধ্যায় বা অন্যত্র কোনও মন্দির তৈরি হইবে কি হইবে না, এইটুকুই এই নবজয়ী ভারতের প্রধান ভাবনা নহে। তাহার প্রধান ভাবনা, পুরাতন মসজিদ ধ্বংস করিয়া মন্দির তৈরি করা যাইবে কি না। সেই অর্থে, এই কর্মসূচি প্রকৃতার্থে নির্মাণের নহে, ইহা অবিনির্মাণের কর্মসূচি। অর্থাৎ ইহা ভাঙিয়া গড়িবার কথা বলে। তাই, যাহা ভাঙা হইতেছে, তাহার দিকে দৃষ্টিপাত আজ বিশেষ জরুরি। বাবরি মসজিদ একটি ‘বিতর্কিত’ স্থাপত্য, তাহার পক্ষে-বিপক্ষে দাবির বয়স শতাধিক। কিন্তু দাবির মীমাংসা তো দুই বা তিন পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ভাবে, সহযোগিতার ভিত্তিতেও হইতে পারিত। পাঁচ শত বৎসর আগেকার ইন্দ্রিয়স্পর্শাতীত সময়ের ‘অন্যায়’ শুধরাইবার সহিত আটাশ বৎসর আগে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে ঘটিয়া যাওয়া অন্যায়ের বিবেচনাও হইতে পারিত। নূতন মন্দির নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হইয়া যাওয়া মসজিদের পুনর্নির্মাণের আয়োজন হইতে পারিত। কিন্তু তাহা হয় নাই, কারণ প্রকৃত লক্ষ্য নির্মাণ নহে, ধ্বংসের প্রতাপ বিচ্ছুরণ। অতীতকে হত্যা করিয়া বর্তমানকে সবক শিখানো।
এই কারণেই, মন্দির-মসজিদ বিতর্ক পার হইয়া আজিকার নবপর্ব গভীরতর ও ব্যাপকতর পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করিতেছে। পরাধীন দেশের যন্ত্রণাদীর্ণ পথে চলিতে চলিতে ভারতীয় নেতারা যে বিশ্বাসে ভর রাখিয়াছিলেন, যে ভবিষ্যৎ রচনায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন, তাহা ছিল সকলকে লইয়া চলিবার পথ। গাঁধীর ‘রামরাজ্য’ বা রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’— দেশের পবিত্রতার ভাবনাটি সঞ্চারিত হইয়াছিল সর্বজনীনতা ও সর্বকুশলতার রসসিঞ্চনে। তাঁহারা বলিয়াছিলেন, ইতিহাসের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ লইতে হয় না, ইতিহাসের অন্যায় ভুলিয়া আহ্বান ও মঙ্গলের বাণীটিকে আঁকড়াইতে হয়। হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খ্রিস্টানির কথা জাতীয় সঙ্গীতের স্তবকে অকারণে স্থান পায় নাই। আজ যখন চিরপরিচিত ভারত-ভাবনার অবসান-লগ্ন ঘনাইয়াছে, এই দুর্দিনে তাঁহাদের শিখানো সকল উদারবাণীকে ব্যর্থ নমস্কারে ফিরাইয়া দেওয়াই বোধ করি নিয়তি।