বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ এল ফোনটা। অচেনা নম্বর। “স্যর, আমি নাসরিন বলছি। আমাদের নাকি আজ রেজাল্ট বার হয়েছে? স্যর, আমি যদি পাশের বাড়ির কাকিমার এই ফোন থেকে আপনাকে রোল নম্বর পাঠাই, আমার রেজাল্টটা বলে দেবেন?”
এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে সকাল সাড়ে দশটায়। মিডিয়া আলো করে ভেসে উঠছে শীর্ষে পৌঁছে-যাওয়া মুখগুলি, লক্ষ চোখের সামনে তারা পেশ করে চলেছে দিনযাপনের খুঁটিনাটি, গৃহশিক্ষকের অবদান, শখ, স্বপ্ন বা উচ্চাশার বিবরণী। গণমাধ্যমে অনভ্যস্ত ঈষৎ লাজুক মুখগুলির অনেকেই অচিরে ক্যামেরার কেন্দ্রে চোখ রেখে ‘সহায়িকা’-বিপণনের মারকাটারি প্রতীক হয়ে উঠবে। তার আভাস তখনও মিলছে না তাদের আড়-না-ভাঙা ভঙ্গিতে। দেখতে পেলাম, অনেক প্রত্যাশিত প্রশ্নমালা পার হয়ে শীর্ষে-থাকা কিশোরটি যখন এই প্রশ্নের মুখোমুখি হল, ‘‘খেলাধুলো করো?’’ একটু থেমে সে জানাল, ‘‘গত তিন বছর খেলতে যাইনি।’’ এইখানে একটা আশ্চর্য সমাপতন লক্ষ করা যাক। গত তিন বছর কোনও খেলাতে (ধরা যাক, নির্ধারিত ‘মেয়েলি’ খেলাগুলিতে) অংশী হয়নি নাসরিনও। ওর অপুষ্টিজনিত রক্তাল্পতা, দিনমজুর বাবার ক্যানসারে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মরে যাওয়া আর বাসাবাড়ি-কাজ-করতে-যাওয়া রুগ্ণ মায়ের রান্নাঘর সামলানোর ফাঁকটুকুতে নাসরিনের কোনও ‘খেলাধুলো’ ছিল না। এবং নাসরিন মাধ্যমিক পাশ করতে পারেনি।
দিনশেষে প্রায় পূর্বপ্রত্যাশিত এই অকৃতকার্যতায় নাসরিন অবাক হল না বিশেষ। প্রশ্নের জবাবে জানাল, এ মাসে রেশনের চাল পেয়েছে। আর ফুলঝাড়ু বিক্রি করে সংসারে এসেছে তেল আর সয়াবিন কেনার মতো টাকা। নাসরিন আর তার মাস্টারমশাইয়ের দিনান্তের এই সংলাপ অনেকগুলি ‘সত্যি’র মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল আমাদের। টের পাওয়া গেল, এমন প্রান্তর-প্রান্তের কোণে নাসরিনদের বসবাস, যেখানে মিডিয়ার শিরোনামে থাকা খবরটুকুও যথা সময়ে পৌঁছয় না।
সেই অন্তরালের পাশাপাশি, আমরা, পেশাদার শিক্ষকেরা, মগ্ন থাকি মার্কশিট-ভিত্তিক সফলতার নিরিখ নির্মাণে। আমাদের সকল মনোযোগের কেন্দ্রে এসে দাঁড়ায় তিনটি জিনিস— অনমনীয় সিলেবাস, প্রতিযোগিতাকেন্দ্রিক পরীক্ষা এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় উপযোগিতা-সূচক মার্কশিট। আড়াল তৈরি হয় শিক্ষক আর পড়ুয়ার মাঝখানে, তাদের মধ্যে সম-অনুভবী সম্পর্কের সম্ভাবনা ব্যাহত হয়। আমরা বিস্মৃত হই ‘সফলতা’ আর ‘সার্থকতা’ শব্দ দু’টির মাঝখানের অর্থবহ ব্যবধানটুকু। সফলতার সূচকগুলিকে লালন করতে করতে আমরা ভুলে যাই, ‘পারফরম্যান্স’-এর বিচারে আমরা যে পড়ুয়াটিকে ‘লজ্জিত’ হতে প্রায় বাধ্য করি, সে হয়তো ইস্কুলের উৎসব দিনে কী আশ্চর্য আলপনা দিয়েছিল আঙিনা জুড়ে! আমাদের কাছে ব্যর্থতা মানে কম নম্বর। অথচ নাসরিন যখন বলে, ‘‘আমি আগামী বছর ঠিক পাশ করব স্যর, আপনি কেবল ইতিহাসটা একটু দেখিয়ে দেবেন’’, তখন তাকে ‘ব্যর্থ’ বলব কোন স্পর্ধায়?
সফলতার উদ্যাপন করে গিয়ে আমরা বেখেয়ালে এক নিরন্তর ‘অপর’ বা ভিন্ন করে রাখার অভ্যাস করে ফেলেছি। এই অভ্যাসের করুণ চেহারা বয়ে নিয়ে আসে কখনও সামাজিক গণমাধ্যমের ভাষা। ‘‘অমুক মেয়েটি এ বারে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে মাধ্যমিকে প্রথম।’’ তফসিলি জনজাতির ক্ষেত্রে আজও ‘আদিম’ বা ‘অপরাধপ্রবণ’ শব্দগুলো ব্যবহার হতে দেখি। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ পরিচিতি ধরে ধরে ‘প্রথম’ কিংবা ‘পাশ’ দেখানোর এই প্রবণতা যেন মনে করিয়ে দেয় যে, ওই ছেলেমেয়েরা আসলে মূলস্রোতের নয়।
অপরায়ণ-প্রবণতা এখন রাজনৈতিক পরিবেশের এক অন্যতম ঝোঁক। আমরা, শিক্ষক-শিক্ষিকারা, কোনও মহৎ পরিবর্তনের ধারণায় যদি এখনও বিশ্বাস রাখি, তবে সর্বস্তরে ক্ষমতার ভাষা ও বয়ানগুলির কাছে সমর্পণের চিহ্নগুলিকে চিনে নিতে হবে আমাদেরই। আজ থেকে ঠিক ১০৮ বছর আগে এমনই এক শ্রাবণ দিনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- “মানুষ মানুষের কাছ হইতেই শিখিতে পারে; ... মানুষকে ছাঁটিয়া ফেলিলেই সে তখন আর মানুষ থাকে না, সে তখন আপিস আদালতের বা কল-কারখানার প্রয়োজনীয় সামগ্রী হইয়া উঠে; তখনি সে মানুষ না হইয়া মাস্টার-মশায় হইতে চায়, তখনি সে আর প্রাণ দিতে পারে না, পাঠ দিয়া যায়।” (শিক্ষাবিধি, ৩১ শ্রাবণ, ১৩১৯)
অনুমান করতে পারি, শান্তিনিকেতনে তাঁর বিদ্যালয় স্থাপনার এগারো বছর পরে কী গভীর উদ্বেগে রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষ’-এর বিপরীতে ‘মাস্টার-মশায়’ শব্দটি রেখেছিলেন। তাঁকেও তো উত্তরকালে ‘পরীক্ষা’, ‘মূল্যায়ন’ ইত্যাদি ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছে।
তাই পেশার পরিসরে যদিও বা পড়ুয়াদের পারফরম্যান্স-এর নিরিখে সফলতার নির্ণয় করতে হয়, তবু নিজস্ব বিফলতার বিষম আবর্তের বাইরে গিয়ে পড়ুয়াটির সঙ্গে একান্ত সংলাপ আর সংযোগ রচনা করতে হবে শিক্ষকদেরই। আমার ভেতরকার ‘ক্ষমতার-আমি’ আরও গাঢ় ভালবাসায় ডুবে গেলে হয়তো অনেক বিরোধ দ্রব হয়ে যাবে। অন্তত দূরত্ব কমে আসবে ক্লাসঘরের সঙ্গে মাঠের, মার্কশিটের সঙ্গে আলপনার, কেন্দ্রবিন্দুর সঙ্গে প্রান্তরেখার। আমরা ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করব।
আর সমান্তরাল কথকতায় ব্যাখ্যা করব মাধ্যমিকের শীর্ষে আসীন মুখগুলোকে, আর নাসরিনের খেলতে না-যাওয়ার গল্পগুলিকে।
অরবিন্দ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, জলপাইগুড়ি