স্বামী বিবেকানন্দ। ছবি: সংগৃহীত
যদিও প্রতিটি দিনই নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে। তবে, জাতীয় যুবদিবস যুবসমাজের কাছে বিশেষ গুরুত্ব রাখে। আমাদের দেশের জনগণের একটি বিরাট অংশ বয়সের নিরিখে যুবক। তথ্য দেখাচ্ছে, ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষের বয়স ৩৫ বছরের মধ্যে। আবার ২৫ বছরের মধ্যে নাগরিক দেশের মোট জনগণের প্রায় ৫০ শতাংশ।
তারুণ্য বয়ে নিয়ে চললেও বিভিন্ন কারণে কি আমাদের সার্বিক উন্নতির পথে হোঁচট খেতে হচ্ছে? যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, তারুণ্য অটুট রাখা যায় মধ্য বয়সের পরেও। তারুণ্যের সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে। কিন্তু ৩৫ বছরের মধ্যের নাগরিক জনসমষ্টির এত শতাংশ জুড়ে থাকার পরও সমাজগঠন ও উন্নতির দিকগুলোয় এ দেশের তরুণসমাজ কতটা জড়িয়ে, তা ভাবার মতো বিষয়। তরুণেরা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে কতটা সুযোগ পান? যাঁরা পান, তাঁরা ব্যতিক্রমী হিসেবেই চিহ্নিত হন। ক্রীড়ায় শারীরিক দক্ষতার পরিচয় দিতে হয় প্রতিটি মুহূর্তে। এখানে তরুণদের অগ্রাধিকার। হয়তো বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেই। কিন্তু ক্রীড়া প্রশাসন? বয়সের বাধানিষেধ না থাকায় তরুণ মুখ সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না।
এমন ছবি সব ক্ষেত্রেই প্রায় এক। জনপ্রতিনিধি থেকে শিল্প— সবেতেই। তবে আশার আলো ও লড়াই এখনও দেশের তরুণেরা বিভিন্ন ভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করছেন। কিন্তু শতাংশেের হিসেবে, সংখ্যায় তাঁরা পিছিয়েই। এই তরুণ বাহিনীর আরও এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল শিক্ষা। চোদ্দো বছর পর্যন্ত সব শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীর শিক্ষার দিকটি আশ্বস্ত করা গেলেও ২০২০ সালেও শিশুশ্রমিক শব্দটি পুরোপুরি অচল হয়ে যায়নি। শিশুদিবসের দিনে তারা সামাজিক মাধ্যমে ভেসে উঠলেও বছরের অন্যান্য দিন অন্ধকারের ভেতর, আরও অন্ধকারে ডুবে থাকে।
এর পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার বিষয়টিও নজরে রাখা দরকার। ব্রিটিশদের দেশ ছাড়ার পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সামগ্রিক শিক্ষা প্রসারিত হয়েছে। নারীশিক্ষা প্রসারিত হয়েছে। উচ্চশিক্ষাও। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা বা তার পরবর্তী ধাপে যত শিক্ষার্থী যুক্ত, তার বড় অংশ উচ্চশিক্ষায় এসে কমে যায়। যদিও বর্তমানে সরকারি কিছু চিন্তাভাবনায় খানিকটা বদল এসেছে। এর বদল সমস্ত গঠনকাঠামোয় উঠে এলেই হয়তো তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে আরও কিছুটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
খাদ্য সমস্যাও একটি দিক। বিশ্ব ক্ষুধার ইনডেক্সে পরিচিত রাষ্ট্রদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ভারত। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের স্থান ১০২। অস্ট্রেলিয়া বা নরওয়ের মতো দেশগুলো এই ইনডেক্সে আসেই না। বলা ভাল, ইনডেক্সে আসার মতো পরিস্থিতি নেই সে সব দেশে।
হাঁটছি তো আমরা সবাই। প্রতিটি দেশই। কিন্তু এগনো? এ প্রসঙ্গে আর যে বিষয়টি সমান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তা অবশ্যই কর্মসংস্থান। চাকরির সুযোগ, জীবিকার দিশা দেখাতে না পারলে প্রজন্মকে ভাঙা শিরদাঁড়াই বয়ে বেড়াতে হয়। সামাজিকতার চেয়ে অসামাজিকতা বেড়ে যায়। আর তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সমান গুরুত্ব এবং সমান পরিসর দেওয়ার সময়ও চলে এসেছে।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, চিন, জাপান, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশে যখন জনগণের গড় বয়স ৪০ বছরের উপর, তখন ভারতের ২৮। প্রবল সম্ভাবনাময় একটি পরিসর! মানবসম্পদ উন্নয়নের দিককে বিশেষ ভাবে সতেজ করে তোলার এটাই তো উপযুক্ত সময়। কিন্তু এরপরও অজস্ৰ দিকে তরুণরা শুধুই শ্রোতা আর দর্শক। যে রাজনীতি আমাদের প্রতিটি দিনকে প্রভাবিত, পরিচালিত করে, তার গঠনকাঠামোয় তরুণ প্রতিনিধিদের অভাব। প্রশ্ন জাগে, কর্তাব্যক্তিরা তরুণদের রাজনীতিতে জড়িয়ে নিলেও জনপ্রতিনিধি পদে তরুণেরা সে ভাবে কোথায়? প্রতিটি বিভাগই তাদের রিজার্ভ বেঞ্চ তৈরি রাখে। সেদিক থেকে রাজনীতি, নীতি নির্ধারণের মঞ্চ পিছিয়ে কেন? প্রশ্ন আসে, জায়গা করে নেওয়া, না কি জায়গা ছেড়ে দেওয়া? এগুলো প্রশ্ন নয়। এগুলোই এক-একটা উত্তর। কোচবিহার থেকে মালদহ, জলপাইগুড়ি থেকে দুই দিনাজপুর— উত্তরবঙ্গের সব প্রান্তেরই জেগে ওঠা দরকার।
স্বামী বিবেকানন্দ যে চিন্তাচেতনা যুবসমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁর কথায়, লেখায়, বাণীতে, সে সবের কাছে নত হয়ে এই নতুন দশকের শুরুতে নতুন ভারতের স্বপ্ন সত্যি করতে পারে যুবসমাজই। যুবসমাজ যে ভাবে ভরসা করতে পারে অগ্রজদের, ঠিক তেমনই ভরসার বিশাল পরিসর হয়েও উঠতে পারে। বহু স্বর, বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু বর্ণের ভারতে প্রতিটি দিনই যুবদিবস। নতুন আবেগ, উন্মাদনা, ধৈর্য, প্রয়াসের এমন সব মিশেল অগ্রজদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে জুড়ে দিলে নিঃসন্দেহে বাড়তি অক্সিজেন পাবে প্রতিদিনের প্রতিটি প্রয়াস। বাকি রইল, ইঁদুরদৌড়। কিন্তু সে তো সময়ের সমস্যা নয়। সে সমস্যা চিন্তাভাবনার। পৃথিবীর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নবীন প্রজন্মের পিঠের ব্যাগের ওজন বাড়ছে! সব শিক্ষায় সমান দক্ষ হওয়ার মনোভাব বাড়ছে! খানিকটা অভিভাবকদের ইচ্ছেতেই! এমন ইচ্ছের উপর দিয়ে সে দিনই সব ইচ্ছেডানা মেলে ধরতে পারবেন যুবরা, যে দিন চার পাশের অস্থিরতার মধ্যেও একটি মুক্ত-স্বাধীন ভাবনার পরিসর থাকবে। সব ক্ষেত্রে খুব নতুন চিন্তারও নয় হয়তো, কিন্তু অবশ্যই নতুন ভাবে চিন্তার।
(লেখক উত্তর খাপাইডাঙ্গা পঞ্চম পরিকল্পনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।মতামত ব্যক্তিগত)