শহর জুড়িয়া যুদ্ধকালীন তৎপরতা। তৎপরতা, শহর জুড়িয়া রাস্তার খানাখন্দ সারাইবার। পুর কমিশনার স্বয়ং রাস্তার হাল দেখিতে পথে ঘুরিতেছেন, সিএমডিএ অস্বাভাবিক দ্রুততায় বাইপাসের ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলি মেরামতে তৎপর হইতেছে, পুরসভার উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হইতেছে, নিজস্ব রাস্তা ছাড়াও অন্য রাস্তা সারাইবার দায়িত্বও তাহারা নিজেরাই লইবে। অথচ দুর্গাপূজা আসিতে এখনও কিছু দেরি, পূজা-সমাগমে খানাখন্দ ভরা রাস্তায় তাপ্পি মারিবার বাৎসরিক কাজটির সময় এখনও হয় নাই। তবে এ হেন তৎপরতা কিসের? কারণটি, মুখ্যমন্ত্রীর ধমক। কিছু দিন পূর্বেই সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত দফতরগুলির সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী রাস্তার বেহাল অবস্থা লইয়া যারপরনাই অসন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন। প্রশ্ন তুলিয়াছেন পূর্ত দফতরের ভূমিকা লইয়াও। মুখ্যমন্ত্রীর ধাক্কা খাইয়া অবশেষে ঘুম ভাঙিয়াছে পুরসভার। সেই কারণেই ভরা বর্ষায় রাস্তা সারাইয়ের অকালবোধন।
কিন্তু প্রশ্ন, ঘুম ভাঙিতে মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়োজন পড়িল কেন? ইহা তো পুর প্রশাসনের দায় এবং দায়িত্ব। বর্ষার জল পড়িলেই কলিকাতার রাস্তার দুরবস্থা তো কোনও নূতন খবর নহে। বৃষ্টি হইলেই রাস্তার উপরের আস্তরণ খসিবে, ব্যস্ত দিনে বিরাট গর্তে জল ভরিয়া যান চলাচল রুদ্ধ হইবে এবং দুর্ঘটনা ঘটিবে— ইহা চেনা ছবি। কিন্তু কোনও কালেই ইহা রুখিতে আগাম ব্যবস্থা লইবার কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ে না। কারণ, পুর প্রশাসনের রং বদল হইলেও দায়িত্ববোধ এবং কাজে স্বচ্ছতার প্রশ্নে তাহা একই জায়গায় থমকাইয়া থাকে। রাস্তার কাজে রাজনৈতিক নেতার প্রচ্ছন্ন মদতে ব্যাপক দুর্নীতি দিবালোকের মতো স্পষ্ট। সেই কারণেই সদ্য মেরামতি হওয়া রাস্তা বৎসর ঘুরিতেই চলাচলের অযোগ্য হইয়া পড়ে এবং ফের মেরামতির কাজে বিস্তর টালবাহানা দেখা যায়। অথচ কোন কোন রাস্তায় অল্প বৃষ্টিতেই জল জমিয়া খানাখন্দ তৈরি হইবার প্রবণতা আছে, তাহা চিহ্নিত করিবার কাজটি বিরাট পরিশ্রমসাধ্য নহে। সেই সব জায়গায় বাড়তি নজরদারি এবং বিকল্প উপাদান সন্ধানে জোর দিলে ফি বৎসর বর্ষা-অন্তে রাস্তা লইয়া মাথাব্যথার উপশম সহজ হইত। কিন্তু দায়িত্বপালনে অনিয়মই যেন দস্তুর পুর প্রশাসনে।
যেমন দস্তুর— রাজ্যের সমস্ত প্রশাসনিক কাজে একেবারে শীর্ষমহল হইতে ধমক আসিলে তবে কাজ আরম্ভ হইবার রীতিটি। অথচ সুস্থ গণতন্ত্রে বিভিন্ন দফতর তাহাদের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করিবে, প্রশাসনের শীর্ষব্যক্তি শুধুমাত্র বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয়সাধন করিবেন, এমনই হইবার কথা। কিন্তু বঙ্গের গণতন্ত্রে উল্টা চিত্র। এখানে ডেঙ্গিদমন হইতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সমস্ত ক্ষেত্রেই মুখ্যমন্ত্রী নিজ হাতে রাশ না ধরিলে কাজ অসম্পূর্ণ থাকে। অবশ্য, সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য প্রশাসনের শীর্ষব্যক্তির আরও একটি ভূমিকাও থাকে। বিভিন্ন দফতরের মধ্যে দায়িত্ববোধ জাগাইবার কাজটিও তাঁহারই। ইহার জন্য তাঁহাকেও ভরসা করিয়া দায়িত্ব ছাড়িতে হয়। যাহাতে অধীন দফতরগুলি স্বাধীন ভাবে নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করিতে পারে। শীর্ষব্যক্তি স্বয়ং সমস্ত কর্তৃত্ব আপন হস্তে লইলে সাধারণ নিয়মেই দায়িত্ববোধ জাগে না। তাহাতে শুধুমাত্র রাস্তার দশা বেহাল হয় না, সমগ্র গণতান্ত্রিক পরিবেশটিই বেহাল হইয়া পড়ে।