ই ংরেজি বছরের প্রান্তে এসে আজ একটু ‘বাঙালি’র কথা! এই বাঙালি অবশ্য আমাদের মতো আমজনতা নয়। এ হল ভোটের বাঙালি। আরও স্পষ্ট করে বললে, ভোটের জমি ‘তৈরি’ করে নেওয়ার বাঙালি। এর জন্য হাত-পা-মুখের অবয়ব লাগে না। দরকার আবেগ সৃষ্টির। রাজ্যের রাজনীতিতে এখন সেই পর্ব শুরু হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ-বিশ্বভারতী-বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দ থেকে অমর্ত্য সেন, সবই ওই প্রক্রিয়ার এক একটি উপকরণ। এই ধরনের আবেগ কতটা আন্তরিক, আর কতটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যবাহী, সবাই তা বোঝেন। তবে সুভদ্র বাঙালির হৃদয়ে যাঁরা সর্বদা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত, রাজনীতির চক্রে তাঁদের টেনে নামাতে চাইলে বলতেই হবে, সেই অভিসন্ধি প্রতিবাদযোগ্য।
বাংলার চিরস্মরণীয় মনীষীদের এবং অন্য খ্যাতিমানদের নিয়ে রাজনীতি এর আগেও হয়েছে। তাঁদের সৃষ্টিকে নস্যাৎ করার অর্বাচীন ঔদ্ধত্য আমরা বার বার দেখেছি। আসলে যাঁরা এ সব করেন তাঁদের অন্ধ চেতনার কাছে ওই মনীষীদের এবং তাঁদের ভাবনার সার্বিক মূল্যায়ন আশা করাও ভুল। নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে তাঁরা ওঁদের কখনও মাথায় তোলেন, কখনও পায়ে ঠেলেন।
সিপিএমের রাজত্বে এই বাংলায় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ সাম্প্রদায়িক বলে নিন্দিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’ পাঠ্যের তালিকা থেকে বাদ হয়েছিল শ্রেণিবৈষম্য ছড়ানোয় অভিযুক্ত হয়ে!
আবার জ্যোতি বসুর সরকার যখন স্কুলের পাঠে ইংরেজি তুলে দেয়, তখন তুমুল প্রতিবাদের মুখে সেই রবীন্দ্রনাথকেই আশ্রয় করে সিপিএম প্রচারে নামে। ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’ লেখা রবীন্দ্র-উদ্ধৃতি তখন তাদের বড় সম্বল!
প্রয়াত মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান থেকে কর্মস্থান অর্থাৎ জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতন পর্যন্ত পদযাত্রার কথাও নিশ্চয় অনেকের মনে আছে। অর্থাৎ, যখন যেখানে যেমন প্রয়োজন, স্মরণীয় ও গুণিজনেরা রাজনীতির অঙ্কে সেই ভাবে ‘ব্যবহৃত’ হয়ে থাকেন।
আর রাজনৈতিক স্বার্থে ঘা লাগলে কত অপমান ধেয়ে আসে, তৃণমূলের আমলে তার বড় প্রমাণ বিশিষ্ট কবি শঙ্খ ঘোষ। সমাজে শঙ্খবাবুর মান্যতা প্রতিষ্ঠিত। কোনও বিষয়ে তিনি কিছু বললে সেই কথার সামাজিক প্রভাব পড়ে। অথচ বঙ্গের সুশীল সমাজ দেখেছে, অতীতে বীরভূমের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল পর্যন্ত কত অবলীলায় শঙ্খ ঘোষ সম্পর্কে আপত্তিকর কথা বলে পার পেয়ে গিয়েছেন।
তবে এখন যেটা হচ্ছে, তার পিছনে ভোটের রাজনীতির একটি বড় ভূমিকা আছে। এই কু-নাট্যের প্রযোজক বিজেপি এবং তার বশংবদেরা। ভোটের কারণেই তৃণমূলকেও পাল্টা পাল্লা দিতে হচ্ছে।
দশ বছরের তৃণমূল-শাসনের ভাল দিক মন্দ দিক, অপর পক্ষে বিকল্প হিসেবে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা, দেশের শাসক হিসেবে তাদের চেহারা— সব কিছু নিয়েই বাংলার ভোট। সেখানে সাম্প্রদায়িক বিভাজন থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব আইন, দুর্নীতি-কেলেঙ্কারি, বঞ্চনা-প্রাপ্তি, অনেক বিষয় আছে। মানুষের রায় কী হবে, সেটা সময় এলে পরিষ্কার হবে। কিন্তু দৌড়ের প্রথম রাউন্ডেই বিজেপির মধ্যে ‘বাঙালি’ হয়ে ওঠার এক তীব্র তাড়না নজরে পড়ছে। যেটাকে বলা যেতে পারে, বাঙালি তাস খেলা! হিন্দু-মুসলিম রাজনীতির মতোই বাঙালি-অবাঙালি রাজনীতি। সোজা কথায়, এই বাংলায় বাঙালির বেশে বিজেপি নিজেকে দ্রুত গ্রহণীয় ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে চায়।
এর প্রয়োজন হচ্ছে কেন?
সত্যি বললে, রাজনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও এই রাজ্যে বিজেপি এখনও প্রকৃত অর্থে বাঙালির পার্টি হয়ে উঠতে পেরেছে কি না, সেই প্রশ্ন অমীমাংসিত। উত্তর যাচাই করলে হয়তো ‘না’-এর ঝোঁকই কিছু ভারী হবে। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়, বিজেপি নেতাদের চালচলন, রীতি-শিষ্টাচার, ভাষা প্রয়োগ ইত্যাদি অনেক কিছুই চেনা বাঙালি-সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না।
দলের বঙ্গনেতারাও সেই ধারাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই মাছে-ভাতে নেই। তাঁরা হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করেন। খাওয়ার চেয়ে ‘ভোজন’ করতে এঁরা বেশি স্বচ্ছন্দ। দলীয় পদাধিকারীদের তাঁরা ‘প্রভারি’, ‘সংগঠন মহামন্ত্রী’, ‘অধ্যক্ষজি’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে থাকেন। কথায় কথায় ‘জানকারি নেই’, ‘আগ্রহ করছি’ বলাও এঁদের মধ্যে খুব চালু।
আপাতদৃষ্টিতে এটা দোষের কিছু নয়। কেউ কী খাবেন, কী পরবেন, কী ভাষায় কথা বলবেন সেটা তাঁদের স্বাধীন বিবেচনা। কিন্তু কোথাও রাজ্য দখলের রাজনীতিতে নামলে এ সবের কিছুটা প্রতিক্রিয়া থাকে। মুখে স্বীকার করুন বা না-করুন, বিজেপির উপরতলার অ-বঙ্গভাষী নেতারাও এই ‘চাপ’ বিলক্ষণ বুঝছেন।
তৃণমূল-বিরোধিতার জায়গা থেকে বা তাদের রাজনৈতিক বক্তব্যে আস্থা রেখে গত লোকসভায় বাংলায় বহু লোক অবশ্যই বিজেপিকে প্রচুর ভোট দিয়েছেন। তবে সেই ভোট ছিল জাতীয় রাজনীতির ভিত্তিতে। এখন সময় বাংলার রাজ্যপাট নির্ধারণের। তাই ‘ভূমি-সংযোগ’ তুলে ধরার লক্ষ্যে বিজেপি এখন ‘বাঙালি’ হয়ে উঠতে মরিয়া। ভিন্রাজ্য থেকে বাংলায় ভোট করাতে আসা নেতাদেরও তারা ‘বাঙালিয়ানা’ শেখাচ্ছে বলে খবর।
এই পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রাখলে রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতী, বিদ্যাসাগর, অমর্ত্য সেনের মতো বিভিন্ন ব্যক্তি বা বিষয় নিয়ে বিজেপির হঠাৎ মেতে ওঠারও একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। (ছবি: বিশ্বভারতী আশ্রম প্রাঙ্গণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, ২০ ডিসেম্বর। সৌজন্য: বিশ্বভারতী) তবে সেটা করতে গিয়ে আরও যা ঘটছে, তাতে আখেরে কতটা লাভ হবে বলা শক্ত।
অমর্ত্য সেনের কথাই ধরা যাক। দেশের বর্তমান সরকার এবং শাসক দলের মত ও পথের বিরুদ্ধে নোবেলজয়ী তথা ভারতরত্ন এই বাঙালি তাঁর মনোভাব গোপন করেন না। গোটা বিশ্ব তাঁর কথা মন দিয়ে শোনে। এখানে ভোটের বাজারে তাঁর কথা বোধবুদ্ধিসম্পন্ন বাঙালির কাছে পৌঁছে যাওয়ার ঝুঁকি এড়াতে বিশ্বভারতীকে ‘ব্যবহার’ করে যে ভাবে অমর্ত্যবাবুকে কালিমালিপ্ত এবং বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা চলছে, যে ভাবে তাঁকে কার্যত মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ, বঙ্গসমাজ কি তা মানতে তৈরি?
অমর্ত্যবাবুর পৈতৃক বাড়ি যদি বিশ্বভারতীর জমি ‘গ্রাস’ করেও থাকে, তার জন্য আইনানুগ পথ খোলা আছে। বিশ্বভারতীর উপাচার্যকে ফোন করে অমর্ত্য সেন নিজেকে ‘ভারতরত্ন’ বলে জাহির করেছেন, এই প্রচার ছড়ানোর উদ্দেশ্য কী? এর প্রমাণ কোথায়? এ বিষয়ে অমর্ত্যবাবুর প্রতিবাদ যদি গ্রাহ্য না হয়, তা হলে উপাচার্যবাবু ঠিক বলছেন, তা-ই বা ধরে নিতে হবে কোন সুযুক্তিতে?
এখনকার বিশ্বভারতীতে কী চলছে, কেন্দ্রীয় শাসকদের রাজনীতি কী ভাবে এর পরতে পরতে বাসা বেঁধেছে, নতুন করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই বাঙালি যাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করে, তাঁর গায়ে কাদা ছেটানোর চেষ্টা বুঝিয়ে দেয়, অমর্ত্যবাবু ‘পক্ষ’-এর লোক নন বলে তাঁকে ‘বিচ্ছিন্ন’ করে দেওয়া আসলে এক সুচিন্তিত ছক।
বঙ্গ-অস্মিতার উদ্যাপনে রবীন্দ্রনাথকে আমরা সবার আগে আঁকড়ে ধরি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সে দিনও বিশ্বভারতীর শতবার্ষিকী উপলক্ষে বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথের মুক্তচিন্তার আদর্শ তুলে ধরে বলেছেন, বিশ্বভারতীতে ভয়ের পরিবেশ যেন না থাকে। কিন্তু আজকের বিশ্বভারতীতে অধ্যাপক বা অশিক্ষক কর্মীদের সামান্য কথা বলার অধিকারও কি সুরক্ষিত?
বিশ্বভারতী অবশ্য একটি উদাহরণমাত্র। কিন্তু প্রশ্নগুলি এখন প্রাসঙ্গিক। আসলে যা বলার তা হল, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান যা-ই হোক, বাঙালির গর্বের নাম এবং বঙ্গ-ঐতিহ্যের গৌরবচিহ্নগুলিকে রাজনীতির স্বার্থে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করা মানে বঙ্গ-আবেগে আঘাত। ভারতরত্ন অমর্ত্যবাবুকে ‘মিথ্যাবাদী’ সাজানোই হোক বা পঞ্চাশ বছর আগে প্রয়াত বিশিষ্ট অভিনেতা জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়ে তাঁর নামে বিজেপির কার্ড দিয়ে আসা— সবই এই প্রক্রিয়ায় একাকার হয়ে যায়।
‘বাঙালি’ হয়ে উঠতে গিয়ে বিজেপি হয়তো সেই ভুলটাই করছে।