পরীক্ষা শেষ হইয়াছিল ১৬ অক্টোবর, ৯ নভেম্বর ফল বাহির হইয়াছে। পরীক্ষার ফল লইয়া আলোচনা চলিতেছে, বেশ কিছু কাল চলিবে। সেই আলোচনার গতিপথ সম্পর্কে সচেতন নাগরিকের উৎসাহ স্বাভাবিক, স্বাস্থ্যকরও। কিন্তু আরও অনেক বৃহত্তর এবং গুরুতর প্রশ্ন: দেশ কোন পথে চলিবে? নির্দিষ্ট করিয়া বলিলে, অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের শনিবারের রায়ের পরে কোন পথে চলিবে ভারতীয় গণতন্ত্র? রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ভারতীয় জনতা পার্টি তথা সঙ্ঘ পরিবারের নায়কনায়িকারা মোটের উপর সমস্বরে বলিয়াছেন, এই রায়ে কাহারও জয় বা পরাজয়ের প্রশ্ন নাই, সমগ্র দেশ তথা জাতি অতঃপর ঐক্যবদ্ধ ভাবে সমৃদ্ধির পথে অগ্রবর্তী হইবে। বিরোধী শিবিরেও প্রায় সার্বজনিক স্বাগতসম্ভাষণ, কেবল তাহার সহিত অনেকেই একটি কথা যোগ করিতেছেন: বিভেদের রাজনীতি আর নহে, মন্দির মসজিদ হিন্দু মুসলমান ছাড়িয়া এই বার যথার্থ ঐক্যের সাধনা শুরু হউক।
প্রশ্ন সেখানেই। বর্তমান শাসকরা যে ঐক্যের মন্ত্র পাঠ করিয়া থাকেন, তাহা কার্যত সংখ্যাগুরুর একাধিপত্য। তাঁহাদের জাতি/জাতীয়তার ধারণায় নিহিত রহিয়াছে সংখ্যাগুরুবাদ। ধর্মপরিচয় সেই সংখ্যাগুরু নির্মাণের প্রধান উপকরণ, কিন্তু বিশ্বাস এবং চেতনার আধিপত্যও কম গুরুত্বপূর্ণ নহে— ধর্মপরিচয়নির্বিশেষে যাঁহারা এই শাসকদের ধ্যানধারণা ও কর্মপন্থার বিরোধী, তাঁহাদের ‘দেশদ্রোহী’, ‘পাকিস্তানপন্থী’, ‘আর্বান নকশাল’ ইত্যাদি রকমারি তকমা দিবার যে তৎপরতা, তাহা সংখ্যাগুরুর আধিপত্যকে একটি সর্বগ্রাসী রূপ দিতে বদ্ধপরিকর। সুতরাং, তাঁহাদের মুখে ঐক্যের বাণী শুনিয়া সুনাগরিক আশ্বস্ত বোধ করিবেন না আতঙ্কিত, তাহা ভাবিবার বিষয়। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁহার কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরের সতীর্থরা দেশকে সত্যকারের ঐক্যের পথে চালনা করিতে চাহিলে সর্বাগ্রে আধিপত্যের ভজনা ছাড়িতে হইবে। সমস্ত ধরনের সংখ্যালঘুকে, সমস্ত প্রকারের বৈচিত্রকে, সমস্ত গোত্রের ভিন্নমতকে কেবল সহ্য করিলে চলিবে না, তাহাদের আত্মপ্রকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সর্বপ্রকারে যত্নবান হইতে হইবে। তাহাই প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্তব্য। এখনও পর্যন্ত শাসকদের কথায় ও কাজে সেই কর্তব্য পালনের আশ্বাস মিলে নাই, মিলিয়াছে তাহার বিপরীত আশঙ্কা। ২০১৯ সালের ৯/১১-র পরে সেই আশঙ্কা বাড়িবে না কমিবে, আপাতত তাহা প্রশ্নমাত্র।
প্রশ্ন রহিয়াছে জনসমাজ সম্পর্কেও। গত দুই বা তিন দশকের ভারতে ধর্মাশ্রিত সংখ্যাগুরুবাদের রাজনৈতিক সাফল্যের পিছনে সমাজের একটি বড় এবং প্রভাবশালী অংশের সমর্থনের বিপুল অবদান আছে। বস্তুত, তাহা আছে বলিয়াই জাতীয় কংগ্রেস সহ বিভিন্ন বিরোধী দল নিজেদের ‘রামমন্দিরের পক্ষে’ বলিয়া জাহির করিতে এতখানি তৎপর। তাঁহারা স্পষ্টতই ভয় পাইতেছেন যে, এই প্রশ্নে বিবাদী স্বর লাগাইলে ভোটদাতারা কুপিত হইবেন— সংখ্যাগুরু ভোটদাতারা। তাহা হইলে? নিবিড় ঘন আঁধারে কোনও ধ্রুবতারাই কি জ্বলিতেছে না? ধ্রুবতারার খবর জানা নাই, কিন্তু এই সমাজের অন্তরেই রহিয়াছে বিস্তর আলোকবর্তিকা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে ক্রমাগত ভাসিয়া আসিতেছে হাতে হাত ধরিয়া, কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া বাঁচিবার, কাজ করিবার, সুখদুঃখ ভাগ করিয়া লইবার সহজ স্বাভাবিক সভ্যতার অগণন সংবাদ। খাস অযোধ্যায় বহু মানুষ আজও বলিতেছেন, রামমন্দির হইলে হইবে, তাঁহারা চাহেন সুস্থ ভাবে, নিশ্চিন্ত ভাবে, আর একটু ভাল করিয়া বাঁচিতে। এই সুস্থ স্বাভাবিকতাই হইতে পারে অসুস্থ অস্বাভাবিক আধিপত্যবাদী রাজনীতিকে প্রতিহত করিবার একমাত্র উপায়। রাজনীতিকে বাদ দিয়া সেই কাজ সম্ভব নহে। তাহার জন্য প্রয়োজন সুরাজনীতির পুনরুদ্ধার এবং পুনরুজ্জীবন। কঠিন পরীক্ষা। আদালতের এজলাসে নহে, সেই পরীক্ষা সমাজের পরিসরে।