এই উদীয়মান ক্ষমতার রূপের সঙ্গে সমাজের ‘শত্রু’ চিহ্নিত করার কথা আলোচনা করেছি। জনপ্রিয়তাবাদ হল সমাজের শত্রু কেননা জনপ্রিয়তাবাদের ধরন হল তা জনকল্যাণকেন্দ্রিক, জনমুখী, এবং জনতাই তার শুরু ও শেষ। এই জনপ্রিয়তাবাদ জাতীয়তাবাদে উদ্বেল, উন্মত্ত হয় না, ভাষা, বর্ণ, জাতি বা অন্য পরিচিতিকে সম্বল করতে পারে, সমাজের নানা আইনবহির্ভূত কাজকে সহ্য করে এবং সংসদীয় সর্বস্বতার বাইরে জনতা বলে একটা কিছুর অস্তিত্ব বজায় রাখে।
এখানেই আবার তার দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা। এ বারের নির্বাচনে সর্বাত্মক ক্ষমতা দেখিয়েছে যে, তা বর্ণ, জাতি, ভাষা, লিঙ্গ ইত্যাদি পরিচিতি ও বিভেদকে অতিক্রম করে সমগ্র জাতির উপর একাধিপত্য বিস্তারে সক্ষম। কঠোরতার প্রতিশ্রুতি এবং বিশৃঙ্খলা দমনের আশ্বাস দিয়ে সে জনপ্রিয়তাবাদী প্রতিরোধকে পরাস্ত করতে পারে।
সে ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তাবাদীদের কী করণীয়? এত দিন তাদের ধারণা ছিল যে, জনকল্যাণমুখী কর্ম প্রসার এবং অসংগঠিত জনতাকে মূল সম্বল করে রাজনীতি করা যাবে। এই পথে প্রবল প্রতিপত্তিশালী আগ্রাসী ক্ষমতার বিরোধিতা বজায় রেখে স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা যাবে। কিন্তু এই বিচারধারায় প্রথম ভুল হল— জনপ্রিয়তাবাদীরা এটা হিসেবে রাখেনি যে ‘জনতা’র বিরুদ্ধে ‘জনগণ’ বা ‘সমাজ’ সমাবিষ্ট হতে পারে, কেননা প্রত্যেকটি পরিচিতিকেই উল্টো উদ্দেশ্যে ঘোরানো যায়। সীমান্ত জেলাগুলিতে দলিত এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে ক্রমবর্ধমান বৈরিতা, উত্তরবঙ্গ বা জঙ্গলমহলে হিন্দুত্ববাদের প্রসার, নিম্নবঙ্গে কিছু জেলায় মতুয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মুসলিম বিদ্বেষ, মধ্যবর্ণের নতুন উত্থান— এই সবকে ঠেকানোর মতো কোনও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অস্ত্র জনপ্রিয়তাবাদীদের কাছে নেই।
এ এক এমন আবহমণ্ডল যেখানে বামপন্থী-সহ সমস্ত দল আধিপত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ— এই সব স্থানে জনপ্রিয়তাবাদীরা আর কী ভাবেই বা আঞ্চলিক আধিপত্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে?
দ্বিতীয়, জনপ্রিয়তাবাদীরা এখনও এর উত্তর খুঁজে উঠতে পারেনি, এত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরেও লোকে ব্যাপক হারে এই আগ্রাসী শক্তিকে সমর্থন করল কেন? বিমুদ্রাকরণ, জিএসটি, কৃষিসঙ্কট, কর্মসংস্থান সঙ্কোচন— কোনও কিছুই তো প্রতিবাদী প্রচার থেকে বাদ যায়নি। ফল প্রকাশের পর তাই বিহ্বল মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা গেল, এত উন্নয়ন হল, কিন্তু লাভ কী হল? লোকে তো অন্য রাজনীতিকেই সমর্থন করল। তা হলে এত উন্নয়ন হয়তো দরকার ছিল না। এই স্বগতোক্তির উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কোনওটাই বলা যায় না, কোনও উত্তর খোঁজার মানেও হয় না। অথচ, এই খেদোক্তির মধ্যে একটা সত্য আছে— যা হল, উন্নয়নের সুফলকে ছাপিয়ে সর্বভারতীয় ক্ষমতার ‘নৈতিকতা’ এক পরাক্রমশালী চরিত্র অর্জন করেছে। উন্নয়নের সুফল বণ্টনে অসাম্য, দুর্নীতি, আঞ্চলিকতা, অন্তর্কলহ, এবং বিশেষত মধ্যবর্ণ ও নিম্নবর্ণের একাংশের বৈরিতাকে কমানো যায়নি। দুর্মুখরা বলবে, উন্নয়নও বেড়েছে, সাম্প্রদায়িকতাও বেড়েছে। আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ সওয়ার হয়েছে উন্নয়নের পিঠে।
এক কথায়, জনপ্রিয়তাবাদীরা এখনও জানে না প্রশাসনের রণনীতি যে বন্ধ দরজায় আটকে গেল, তাকে কী উপায়ে খোলা যাবে। অথচ অর্থনৈতিক সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটাতে গেলে ১৯০ বিলিয়ন ব্যাঙ্ক ঋণ শোধ করতে হবে। কী ভাবে বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে, কী ভাবে ভোক্তার ব্যয়বৃদ্ধি ঘটতে পারে? ইতিমধ্যে যে বারো জন ঋণগ্রহীতাকে ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা দেউলিয়া আদালতে পাঠাল, তার মধ্যে মাত্র পাঁচটি ব্যবসায় বিক্রি হয়েছে এবং গড়ে ৩৯ শতাংশ ঋণ ফেরত পাওয়া গিয়েছে। আদিম পুঁজি সঞ্চয়, আর্থিক সঙ্কট এবং কৃষিসঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের অর্থনীতি অব্যাহত থাকবে। এর সঙ্গে চলবে জনপ্রিয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে তকমা লাগানো, এরা বেহিসেবি, এরা মজুরি নিয়ন্ত্রণ করে না, এরা খালি পুজোয় আর ক্লাবে টাকা দান করে, ইমামভাতা দান করে। আসল উন্নয়নের পথে এই সব কিছুই হল বাধা, ‘রোডব্লক’, অর্থাৎ সমাজের শত্রু। জনগণ এই মেকি শাসকদের ছুড়ে ফেলবে। এর উত্তর কী? শাসনের রাজনীতি কোন পথে গেলে এই রাজনৈতিক সঙ্কট কেটে বেরিয়ে আসা যাবে? কোনও উত্তর নেই। যদি আইনবহির্ভূত প্রশাসন, রাজনীতি ইত্যাদি ছাড়া অন্য কোনও পথ না থাকে, তবে আদানি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে ঋণ দান, রাডিয়া টেপ ইত্যাদি যে সব আইনবহির্ভূত কাজ গত কুড়ি বছরে হয়েছে, তার মাত্রা ও ভূমিকা যে আলাদা, এবং অসংগঠিত মানুষকে যে ছোটখাটো বেআইনি কাজ করেই বেঁচে থাকতে হয়, তার নৈতিক দাবি জনপ্রিয়তাবাদীদের জোর করে বলতে শোনা যায় না। তারা যেন নিজেদের ভেতরেই হেরে বসে আছে, যুদ্ধের আগেই অস্ত্রসমর্পণ করেছে।
তৃতীয়, সম্পদ ও উদ্যাপন এই দুইয়ের প্রতি জনপ্রিয়তাবাদীদের এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরকে নৈতিক আক্রমণের লক্ষ্য করে তোলে। কারা জনপ্রিয়তাবাদী? যাদের কোনও নীতি নেই, শুধু জনতাকে তৃপ্ত করতে ব্যস্ত। তাই ইমামভাতা, তাই দুর্গাপুজোয় সরকারি ব্যয়, তাই মা মাটি উৎসব, তাই এত ছুটি, দক্ষিণেশ্বরে দর্শনার্থীদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা, পরিকাঠামো উন্নয়নের নামে পাড়ার ক্লাবকে অর্থদান— এই সবই হল সম্পদ অপচয় এবং এক অহেতুক উদ্যাপনের মনোভাব। কৃচ্ছ্রতা সাধনের মনোভাব জনপ্রিয়তাবাদীদের নেই। তাই তাদের প্রশাসিত রাজ্য দুর্বল। তাই তারা আর্থিক প্রগতি আনতে অপারগ। এ দিকে জনসমাবেশের মধ্যে ক্রমাগত তৃপ্তি পাওয়ার এবং বিভিন্ন কারণে উদ্যাপনের এই ভঙ্গি যদি জনপ্রিয়তাবাদীরা ত্যাগ করে, আমলাতান্ত্রিক মনোভঙ্গি নেয়— তা হলে তারা আর জনপ্রিয়তাবাদী থাকে না। তা তাদের অস্তিত্বের সঙ্কট আনবে। অন্য দিকে নয়া উদারনীতিবাদীদের কাছে তাদের ক্রমাগত জবাবও দিতে হবে, তারা কি দরিদ্র নয়? তবে তারা কেন এত খরুচে, এত অপব্যয়ী? এই অপব্যয়ের কারণেই তো উন্নয়ন হয় না। এরা উন্নয়নের শত্রু। কারণ, এরা পুঁজি গঠনে বাধা দেয়। এরা খালি ভোক্তা, উৎপাদক নয়।
কিন্তু, সম্ভবত সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল, জাতীয়তাবাদীদের আলাপচারী রাজনীতি অনুসরণ করার ক্ষমতা দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। এক দিকে জনতার মাঝে নানা আস্থাকেন্দ্রিক সম্পর্ককে আঁকড়ে টিকে থাকার মরিয়া চেষ্টা, তাই তাদের ভ্রাম্যমাণতা, জনসমাবেশ, নানা উৎসব উদ্যাপন, অন্য দিকে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি সম্পর্কে অনীহা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যার মূল কথা, ‘জনতার মাঝে বন্ধু আছে, রাজনীতিতে বন্ধু নেই।’
কিন্তু বন্ধু ছাড়া রাজনীতি চলবে কী করে? জ্যোতি বসু দেখিয়েছিলেন, রাজনীতিতে ফ্রন্ট বা মোর্চার গুরুত্ব। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির হালহকিকত সম্যক না বুঝলে, মোর্চা তৈরি হবে কী করে, আর বন্ধুই বা পাওয়া যাবে কী করে? জনপ্রিয়তাবাদীরা হয়তো এ রাস্তা ধরতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের কায়দায় কংগ্রেসকে আকুল ভাবে জড়িয়ে ধরতে পারে না। অন্য দিকে এই সর্বব্যাপী ক্ষমতার সামনে বন্ধুত্ব ছাড়া বাঁচাও অসম্ভব। তখন বামপন্থীদের মতো আত্মসমর্পণ করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিসর্বস্ব বামপন্থীদের সামনে অন্য কোনও পথ নেই। কিন্তু জনপ্রিয়তাবাদীরা কোন নতুন পথে যাবে? কোনও নতুন বিকল্প কি সম্ভব, যার সাহায্যে জনপ্রিয়তাবাদীরা নিজস্ব রাজনীতির স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারে, আবার বন্ধু সংগ্রহও করতে পারে, এবং তার মাধ্যমে পরাক্রমশালী এই নতুন ক্ষমতার বিরোধিতা করতে পারে?
এই উদীয়মান ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সাফল্য লাভ করা জনপ্রিয়তাবাদীদের পক্ষে দুরূহ। জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতি জনতার সমাবেশ করতে পারে, কিন্তু প্রশাসনিক পদ্ধতি ও সংস্কৃতিতে কোনও পরিবর্তন আনতে পারে কি? পশ্চিমবঙ্গের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, কিছুটা পারে। কিন্তু যে হেতু জনপ্রিয়তাবাদী রাজত্বে প্রশাসনিক বর্ম অত পুরু নয়, বা প্রশাসন দলীয় সাহায্য পায় না, বড় ধাক্কা এলে ধাক্কা সামলানো শক্ত হয়ে পড়ে। আর্জেন্টিনা, গ্রিস, ভেনেজ়ুয়েলা, সর্বত্র একই কাহিনি। ভারতে পরিস্থিতি আরও জটিল। আর্জেন্টিনা ও গ্রিসে জনপ্রিয়তাবাদীদের আত্মসমর্পণ করতে হল আন্তর্জাতিক পুঁজির কাছে। যদি জনতা দেখে যে জনপ্রিয়তাবাদী শাসক তাদের রক্ষা করতে পারছে না, তখন তারা জনপ্রিয়তাবাদী শাসককে নেকড়ের মুখে ছেড়ে চলে যাবে।
একটাই প্রশ্ন। উদীয়মান ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধের পথ তবে কী? জনপ্রিয়তাবাদীদের সারি থেকে কোনও আধুনিক শাসক কি উঠে আসবে, যে একাধারে জননেতা, অন্য দিকে শক্ত প্রশাসক? যে শাসন পার্টিকেন্দ্রিক নয়, অথচ গণশাসন ও তার জন্য উপযুক্ত সংগঠনকে মূল্য দেয়?
পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয়তাবাদের এই নতুন বিবর্তন ঘটবে কি না, তা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমার নিজের ধারণা, জনপ্রিয়তাবাদের বিবর্তনের সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়নি। পপুলিজ়ম শুধু কৌশলসর্বস্ব রাজনীতি নয়। তার রণনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশের সম্ভাবনা আছে। তার প্রয়োগপদ্ধতির ভিত্তিই হল সমাজের বিভিন্ন ফাটল, যাকে অবলম্বন করে তার স্ফুরণ হয়। আগ্রাসী সর্বভারতীয়তার প্রতিরোধ করা তার রক্তে।
(শেষ)
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ‘প্যাসিভ রেভলিউশন ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল’ গ্রন্থের লেখক