প্রতীকী ছবি।
কলিকাতা হইতে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর একটি ফোন গেল নয়াদিল্লিতে, যোগাযোগমন্ত্রী সুখরামের নিকট। দুই পক্ষই বলিলেন, ‘হ্যালো’, এবং ইতিহাস রচিত হইল। ১৯৯৫ সালের ৩১ জুলাই। এই ফোনটিই ছিল ভারতে মোবাইল ফোনের প্রথম বার্তালাপ। নব্বইয়ের দশক ভারতীয় অর্থনীতির মুক্তির দশক। তবে, টেলিকমের মুক্তির বীজটি রোপণ করা হইয়াছিল এক দশক পূর্বেই, রাজীব গাঁধীর তত্ত্বাবধানে। দেশের প্রতিটি প্রান্তে পিসিও পৌঁছাইয়া দেওয়াই হউক কি ক্ষেত্রটির সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা, ভারতে টেলিকম বিপ্লবের সূচনা রাজীব গাঁধীর হাত ধরিয়াই। মোবাইল পরিষেবার দরজাটি বেসরকারি লগ্নির জন্য খুলিয়া দেওয়া তাহারই উত্তরাধিকার, বলা চলে। অনস্বীকার্য, মোবাইল ফোন যে ভাবে ভারতে একটি পর্বান্তর ঘটাইয়াছে, তাহার তুলনা বিরল। আধুনিক অর্থনীতিতে তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। মোবাইল ফোন সাধারণ মানুষকে সেই তথ্যের অধিকার দিয়াছে। একটি মোবাইল ফোনের কল্যাণে মৎস্যজীবীরা সমুদ্রে থাকিতে খবর পাইতেছেন, কোন বাজারে পৌঁছাইলে অধিকতর দাম মিলিবে। যক্ষ্মারোগীর মোবাইলে আসা মেসেজ তাঁহাকে সময়ে ঔষধগ্রহণের কথাটি স্মরণ করাইয়া দিতেছে। অদক্ষ শ্রমিক কাজের খবর পাইতেছেন, অসুস্থ ব্যক্তি অপেক্ষাকৃত সহজে যোগাযোগ করিতে পারিতেছেন চিকিৎসকের সহিত। মোবাইল ফোন-পূর্ব জীবন কেমন ছিল, অনেকেই হয়তো আর স্মরণ করিতেও পারিবেন না।
এই অতিমারি-লাঞ্ছিত সময়ে মোবাইল ফোন কার্যত মানুষের শ্বাসবায়ু হইয়াছে। কিন্তু, এই বিপন্নতার সম্মুখীন হইবার পূর্বেও, মোবাইল ক্রমেই মানুষের দৈনন্দিনতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হইয়া উঠিয়াছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে যাহা ছিল অতি উচ্চবিত্তের বিলাস— এক মিনিট কথা বলিতে খরচ হইত ২৪ টাকা— মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে গোটা দেশের যে কোনও প্রান্তে ফোন করিবার খরচ নামিয়া আসিল শূন্যে। অস্বীকার করিবার উপায় নাই, এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনটি ঘটিয়াছে বাজারের মন্ত্রেই— বাজারের অধিকতর দখল লইবার অনিঃশেষ প্রচেষ্টায় সংস্থাগুলি প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটাইয়াছে, ব্যবহারের খরচ কমাইয়াছে। বাজারটি এখনও সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক নহে, সত্য। এবং, যেটুকু প্রতিযোগিতা আছে, তাহাও ধ্বংস হইয়া বাজারটি আরও বেশি একচেটিয়া দখলে চলিয়া যাইতে পারে, এই আশঙ্কাও পূর্ণ মাত্রায় বর্তমান। সেই প্রবণতাকে প্রতিহত করিতে হইবে। কারণ, ভারতের টেলিকম বাজার দেখাইয়া দিয়াছে, প্রতিযোগিতা কী ভাবে গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা করিতে পারে। সিংহভাগ নাগরিককে তথ্যের অধিকার দিয়াছে বাজার, মোবাইল পরিষেবার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে আরও এক বার কথাটি স্মরণ না করিলে অন্যায় হইবে।
সব ভালরই মন্দ দিক থাকে। মোবাইল পরিষেবাও ব্যতিক্রম নহে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিক করিয়াছে মোবাইল। কিন্তু, তাহা বৃহত্তম বিপদ নহে। যতই উপযোগী হউক, মোবাইল ফোন ব্যবহার করিবার বা না করিবার সিদ্ধান্তটি লইবার অধিকার ব্যক্তির থাকা জরুরি। গত কয়েক বৎসরে রাষ্ট্র এই কথাটি ভুলিয়াছে। যে হেতু কার্যত সব রাষ্ট্রীয় পরিষেবাই এখন আধার-সংযুক্ত, এবং যে হেতু আধারের পরিচিতির কেন্দ্রে রহিয়াছে ব্যক্তির মোবাইল ফোন নম্বর, ফলে এখন মোবাইল ব্যবহার না করিবার সিদ্ধান্তের অর্থ সমস্ত রাষ্ট্রীয় পরিষেবার অধিকার ত্যাগ করা। কেন, তাহার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর সরকার দেয় নাই। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয়, ব্যক্তির পরিচিতিকে একটি পণ্যের সহিত অবিচ্ছেদ্য ভাবিবার মধ্যে বিপুল গোলমাল আছে। বিশেষত সেই পণ্যের ক্ষেত্রে, যাহাকে রাষ্ট্র নজরদারির সহজ আয়ুধ হিসাবে ব্যবহার করিতে পারে। মোবাইলের উপযোগিতার উদ্যাপনের স্রোতে এই আশঙ্কাটি ভাসিয়া গেলে বিপদ।