অতিমারির সম্মুখে দাঁড়াইয়াও ভারত যে তাহার গণপ্রহারের নবলব্ধ ধারাটি ভুলিয়া যায় নাই, মহারাষ্ট্রের পালঘরের ঘটনা প্রমাণ করিয়া দিল। সেখানে দুই সাধু-সহ তিন জন নিরীহ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটিল উন্মত্ত জনতার হাতে। অনুমান, গণপ্রহারের হেতু সমাজমাধ্যমে ছড়াইয়া পড়া একটি গুজব, গ্রামে ‘ছেলেধরা’ আসিয়াছে এবং তাহারা শিশুদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাটিয়া লইবে। দুর্ভাগ্যবশত, নিহতদের গাড়িটি তাহাদের সম্মুখে পড়িয়া গেলে সাধুদেরই চোর সন্দেহে পাথর, লাঠি লইয়া নৃশংস প্রহার করা হয়। আরও গুরুতর অভিযোগ, ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত ছিল, অথচ প্রয়োজনীয় সক্রিয়তা দেখায় নাই। বরং সমগ্র হত্যাকাণ্ডটি কার্যত তাহাদের সম্মুখেই ঘটিয়াছে।
গণপ্রহারের একটি ধারা কিছু কাল পূর্বে বিভিন্ন রাজ্যে শাখাপ্রশাখা মেলিতেছিল। মধ্যে কিছু দিন বিরতির পর তাহা যে ফের স্বমহিমায় ফিরিয়া আসিয়াছে। সামান্য গুজবকে কেন্দ্র করিয়া ঘটিয়া যাওয়া এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। কিন্তু বিষয়টি লইয়া যে রাজনৈতিক খেলা শুরু হইয়াছে, তাহা আরও উদ্বেগের। বিজেপি স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই অ-বিজেপি সরকার শাসিত রাজ্যে হিন্দু সাধুদের নিহত হইবার ঘটনাটিতে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজিয়া পাইয়াছে। ইতিপূর্বেই তাহারা অভিযোগ তুলিয়াছিল, বিষয়টি লইয়া মহারাষ্ট্রের শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস জোট সরকার যথেষ্ট তৎপরতা দেখাইতেছে না। এবং তাহাদের দাবি, ঘটনাস্থলে এনসিপি এবং সিপিএম-এর নেতা ও পঞ্চায়েত সদস্যদের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। সুতরাং, বিজেপি-র প্রশ্ন, গণপ্রহারের ঘটনাস্থলে রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতি কি ঘৃতাহুতি দিবার উদ্দেশ্যেই? অভিযোগের পশ্চাতে সাম্প্রদায়িক খোঁচার চিহ্নটি স্পষ্ট। চুপ নাই কংগ্রেসও। তাহাদের পাল্টা অভিযোগ, অভিযুক্তদের অধিকাংশই গেরুয়াবাহিনীর সদস্য এবং বিজেপি ইচ্ছাকৃত ভাবেই সমগ্র ঘটনাটিতে সাম্প্রদায়িক রং লাগাইবার চেষ্টা করিতেছে। অবস্থা এমনই যে, মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে-কে বিবৃতি দিয়া বলিতে হইয়াছে, পালঘরের ঘটনাটি নিতান্তই গুজব, এবং গ্রামবাসীদের ভ্রান্ত ধারণার পরিণতি। তাঁহার বক্তব্য, এই ঘটনার কোনও সাম্প্রদায়িক প্রেক্ষিত নাই। জানা গিয়াছে, মহারাষ্ট্র সরকার অবশেষে নড়িয়া বসিয়াছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নাকি তাহারা ব্যবস্থা লইয়াছে। প্রসঙ্গত, মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১০১ জন অভিযুক্তের তালিকা প্রকাশ করিয়া জানাইয়াছেন, ইহাতে এক জন মুসলিমেরও নাম নাই। সাম্প্রদায়িক তত্ত্বের প্রণেতাদের দাবি ধোপে টিকিবার নহে।
এই চাপানউতোরের রাজনীতিটি বিপজ্জনক বলিলেও কম হয়। ভারতে এখন সামাজিক ও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা পাকাপোক্ত স্থান করিয়া লইয়াছে। যে কোনও ঘটনার পশ্চাতে সত্য সন্ধান না করিয়া এক সঙ্কীর্ণ আক্রমণাত্মক প্রবণতার দিকে মানুষ সহজেই আগাইয়া যাইতেছে। সামান্য ঘটনাতেও রাজনৈতিক রং লাগে, সাম্প্রদায়িকতার মেঘ জড়ো হয়। ঠিক যেমন তবলিগি জামাতের ঘটনা লইয়া সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছিল। আইনশৃঙ্খলার অবনতি দুশ্চিন্তার কারণ বটেই, কিন্তু যে কোনও ঘটনাতেই এমন সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থপ্রণোদিত রাজনীতি গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎটিই ধ্বস্ত করিতেছে।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)