কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ আর অর্জুনের এক অনন্ত সংলাপ। এই একটি বাক্যে ধরে ফেলা যায় মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী আর জওহরলাল নেহরুর আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা পত্রালাপকে। জওহরলালের সারথি তিনি, সখাও তিনি— মিত্র, অভিভাবক, পরামর্শদাতা, আবার কখনও পরামর্শপ্রার্থীও বটে। অন্য দিকে, এই ধর্মযুদ্ধে যে অর্জুন হওয়ার যোগ্যতা মাত্র এক জনেরই আছে, বিলক্ষণ জানতেন গাঁধী। পিতা-পুত্রের একমাত্রিক সম্পর্কের পরিসরে তাঁদের এই পারস্পরিকতাকে আঁটিয়ে ওঠা কার্যত অসম্ভব।
অথচ, সম্পর্কের অবয়বটি পিতা-পুত্রেরই। প্রথম কয়েক বছর জওহরলালের চিঠির উত্তরে গাঁধী নিজের নামটি লিখতেন ‘এম কে গাঁধী’। ১৯২৫ সাল নাগাদ, বাহ্যিক কোনও কারণ ছাড়াই, তা পাল্টে হয়ে গেল ‘বাপু’, প্রাপকের সম্বোধনটিও ছোট হয়ে দাঁড়াল জওহর। উল্টো দিকে, জওহরলালও ক্রমে সর্বজনীন ‘বাপুজি’ থেকে চলে এলেন ব্যক্তিগত ‘বাপু’-তে। এই ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার কথা বিলক্ষণ জানতেন মোতিলাল। পুত্রের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পার্থক্য ছিল তাঁর, কিন্তু তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল জওহরের জন্য রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ১৯২৭ সালে গাঁধীর কাছে ছেলের হয়ে সুপারিশ করলেন মোতিলাল— মাদ্রাজ কংগ্রেসে সভাপতি করা হোক জওহরকে। তার আগেই অবশ্য কংগ্রেসের অলিন্দে ভাসতে আরম্ভ করেছে প্রস্তাবটি, এবং স্বয়ং জওহরলাল লন্ডন থেকে বাপুকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, সভাপতিত্বে তিনি আগ্রহী নন, কারণ “ঈশ্বরের ওপর দায় ছেড়ে দিয়ে বসে থাকা (জওহরলালের মতে, কংগ্রেস নেতারা এই কাজটিই করছিলেন) অশুভ শক্তির সঙ্গে লড়ার দুর্বলতম পন্থা।” জওহরের অনিচ্ছায় সায় দিয়েছিলেন গাঁধী।
আট বছর পরে, ঘটনাচক্রে জওহরলাল তখন আবারও বিদেশে, গাঁধীই রাজি করালেন কংগ্রেসের লখনউ অধিবেশনের সভাপতি হতে। কংগ্রেসের সহকর্মীদের প্রতি জওহরলাল তখন আরও অনেক বেশি বীতশ্রদ্ধ, তিক্ত— অচলায়তনের সঙ্গে লড়তে লড়তে ক্লান্ত। গাঁধীকে লিখলেন, “আমি যে বিষয়গুলোকে তুচ্ছ মনে করি, ওদের কাছে সেগুলোই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমার কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ, ওদের কাছে তা মূল্যহীন।” নিজের সমাজবাদী আদর্শের কথাই বলছিলেন নেহরু, যে প্রশ্নে পটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদরা তো বটেই, গাঁধীকেও তিনি পাশে পাননি। এই অসেতুসম্ভব দূরত্বের কথা মাথায় রেখেও গাঁধী সভাপতিত্বের প্রশ্নে নেহরুর সম্মতি আদায় করেছিলেন।
কী পাল্টেছিল এই আট বছরে? নেহরু সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন বাপুর? গাঁধী বুঝেছিলেন, তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই চলবেন জওহর? আসলে সম্পূর্ণ উল্টোটাই ঘটেছিল। ১৯২৮ সালের জানুয়ারিতেই একটা চিঠিতে নেহরু সুতীব্র আক্রমণ করেছিলেন গাঁধীর রাজনীতির একেবারে মৌলিক কিছু অবস্থানকেই। রাম রাজ্য? “আমি মনে করি না যে অতীতেও তথাকথিত রাম রাজ্য বস্তুটি ভাল ছিল, এবং চাই না যে তা ফিরে আসুক।” দরিদ্রনারায়ণ? “দারিদ্রের মূলগত কারণ নিয়ে আপনি একটা কথাও উচ্চারণ করেন না। জমিদারি ব্যবস্থা বা ধনতান্ত্রিক শোষণ নিয়ে কিছু বলেন না।” খাদি? “খাদির হাত ধরে কী ভাবে স্বরাজ আসবে, আমি দেখতে পাচ্ছি না।” এই আট বছরে গাঁধীর ‘অন্তরাত্মার ডাক’-কে রাজনীতির সঙ্গে মেলাতে না পেরে হতাশ এবং অধৈর্য হয়েছেন নেহরু, পুঁজিপতিদের গরিব মানুষের অছি হিসেবে দেখার প্রকল্পতে স্তম্ভিত হয়েছেন, লবণ সত্যাগ্রহের পরিকল্পনায় প্রথমে বিচলিত হয়েও পরে মুগ্ধ হয়েছেন গাঁধীর রাজনৈতিক কল্পনাশক্তিতে। এবং জানিয়েছেন, কী ভাবে কংগ্রেসের ভিতরে কায়েমি স্বার্থরক্ষার প্রবণতায় তাঁর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু, এই মনান্তরই শেষ কথা নয়। জওহরলালের এই চিঠিগুলো, এবং তাঁর ডায়েরির লেখা, আত্মজীবনী, সব মিলিয়ে পড়লে স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটাই সুর— কংগ্রেসের নির্বান্ধব পরিসরে গাঁধীই তাঁর পথপ্রদর্শক, অভিভাবক, বন্ধুও। যত বার গাঁধী সরে গিয়েছেন অবস্থান থেকে— বা, নেহরুর মনে হয়েছে সে কথা— তত বার সেই ব্যাকুলতা বেরিয়ে এসেছে স্বভাব-অধৈর্য নেহরুর চিঠিতে।
এই নির্ভরশীলতা পড়ে নিতে ভুল করেননি গাঁধী। তিনি কি নেহরুকে নিয়ন্ত্রণ করতে সুকৌশলে ব্যবহার করেছিলেন এই অসহায় নির্ভরশীলতাকেই? একাধিক বার তিনি জানিয়েছিলেন, নেহরুর সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, তাকে জনসমক্ষে এনে দু’জনের পথ পৃথক করে নেওয়া ভিন্ন গতি নেই। প্রতি বারই নেহরু পিছিয়ে এসেছেন তাঁর অবস্থান থেকে। কখনও আবার নেহরুকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আদর্শগত তাড়নায় রাজনীতির বাস্তবকে ভুললে চলবে না। কিন্তু, শুধু এইটুকুই কি? গাঁধী স্বীকার করে নিয়েছেন নিজের সীমাবদ্ধতা, বারংবার। বলেছেন, “আমি যেখানে তোমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারব না, সেখানে তোমারই তো কর্তব্য আমায় সঙ্গে নিয়ে যাওয়া।” আন্তর্জাতিক ঘটনাক্রমের তাৎপর্য বুঝতে চেয়েছেন সন্তানসম বন্ধুর কাছে। নেহরু যখন বিরূপ হয়েছেন কংগ্রেসের সতীর্থদের প্রতি, গাঁধী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, নেহরুর তুলনায় তাঁদের বিশ্বদর্শন অতি সীমিত, ফলে রাগ না করে তাঁদের বোঝা ও বোঝানোর চেষ্টা করা উচিত। এবং, বারে বারে জানিয়েছেন, নেহরু যে তাঁর কাছে কোনও রাখঢাক না করেই মনের কথা বলতে পারেন, তার জন্য তিনি কৃতজ্ঞ।
শুধু কি রাজনৈতিক পরিসরেই এই আদানপ্রদান? কমলা নেহরু যখন ইউরোপে মৃত্যুশয্যায়, বাপুর নির্দেশে কার্যত প্রতি দিন চিঠি লিখতে হত জওহরলালকে— কমলার স্বাস্থ্যের খবর দিয়ে। জবাবি চিঠিতে বন্ধুর মতো শুশ্রূষা করতেন নেহরুর মনের— যিনি এক চিঠিতে বাপুকে লিখতে পেরেছিলেন, “কমলার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি, মনোমালিন্য যা-ই হোক না কেন, সে শরীরে হাত রাখলে আমার শরীরে শিহরন খেলে যেত।” এ কথা তো কেবল সখাকেই বলা যায়। মনে পড়তে পারে, দক্ষিণ আফ্রিকায় টলস্টয় ফার্মের দায়িত্বে থেকে যাওয়া পুত্র মণিলাল একটি মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ে সে কথা জানানোয় বাপুর প্রতিক্রিয়া ছিল, “ছেলের মনে যৌন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে!” এই তিরস্কার সন্তানের জন্য, সখার জন্য নয়।
নেহরুর নিঃসঙ্গতা অনেক প্রকট ছিল। কিন্তু, স্বজন-পরিবৃত গাঁধীরও কি অপেক্ষা ছিল না এমন কারও, যে সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালবেসেও অস্বস্তিকর প্রশ্ন করতে পিছপা হবে না, ভক্তি যার মেধাকে আচ্ছন্ন করবে না? এমন এক জন, যে বৌদ্ধিক স্তরে দোসর হতে পারবে তাঁর? নেহরুও যে তাঁকে সম্পূর্ণ বোঝেননি, গাঁধী জানতেন। এটাও জানতেন, যদি কেউ বোঝেন, শেষ অবধি নেহরুই বুঝবেন। ১৯৪২ সালে এক বক্তৃতায়, গাঁধী বলেছিলেন, “যবে থেকে জওহরলাল আমার জালে ধরা পড়েছে, তবে থেকেই সে আমার সঙ্গে লড়ে চলেছে, প্রতিরোধ করে চলেছে আমায়। সে বলে, সে আমার কথা বুঝতে পারে না। আর, সে যে ভাষায় কথা বলে, সেটাও আমার নিতান্ত অচেনা। কিন্তু, যেখানে হৃদয়ের মিল, সেখানে কি ভাষা কোনও অন্তরায় হতে পারে?” গাঁধী জানতেন, যত বারই আঘাত করা হোক, জলকে যেমন ভাগ করা যায় না, তিনি আর জওহরলাল তেমনই অবিচ্ছেদ্য। নেহরুর প্রয়োজন ছিল তাঁকে— ঠিক যেমন, তাঁরও প্রয়োজন ছিল নেহরুকে। আর কিছুর জন্য যদি না-ও হয়, গাঁধী জানতেন, যখন তিনি থাকবেন না, নেহরু কথা বলবেন তাঁরই ভাষায়।
গাঁধীর নিধনের পরে বেতার-বার্তায় নেহরু বলেছিলেন, “আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক আলো নিবে গেল।” বহুবচনটি বাহুল্যমাত্র। সেই মুহূর্তে সম্পূর্ণ নির্বান্ধব হয়েছিলেন একা জওহরলাল। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে গাঁধী বলেছিলেন, “আমি এখনও আছি, তাই জওহরলাল আমার সঙ্গে ঝগড়া করে, লড়াই করে। আমি যখন থাকব না, কার সঙ্গে লড়বে ও? আর কে-ই বা সহ্য করবে ওর সেই আক্রমণ?”
অন্যরা নেতা হারিয়েছিলেন, বাপু হারিয়েছিলেন, কিন্তু নেহরু হারিয়েছিলেন তাঁর সারথিকে— এবং, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হতে তখনও অনেক বাকি।
ঋণ: টুগেদার দে ফট: গাঁধী-নেহরু করেসপন্ডেন্স ১৯২১-১৯৪৮; সম্পা: উমা আয়েঙ্গার ও ললিতা জাকারিয়া, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১১