Tejashwi Yadav

ক্ষমা চাওয়ার কৌশল

বাবা লালুপ্রসাদ যাদব ও মা রাবড়ী দেবীর ১৫ বছরের শাসনে যা ভুল হয়েছে, তার জন্য ক্ষমা চাইলেন রাষ্ট্রীয় জনতা দলের প্রধান তেজস্বী যাদব।

Advertisement

বদ্রী নারায়ণ

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share:

রাষ্ট্রীয় জনতা দলের প্রধান তেজস্বী যাদব।

ভারতীয় মনে বেশ প্রভাব ফেলে ক্ষমা চাওয়া ব্যাপারটা। ভারতীয় ঐতিহ্যের চৌহদ্দিতে গড়ে ওঠা সমাজমনেই তো আমরা বড় হয়েছি। তা আমাদের শিখিয়েছে, ক্ষমা চাওয়া এবং ভুল স্বীকার করা হল গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় মূল্যবোধ। কেউ যদি তা প্রার্থনা বা ভিক্ষা করে, তা হলে অভিযোগ ও কষ্ট লাঘব হয়, এবং যাঁরা কোনও কারণে রেগে গিয়েছেন তাঁরা নরম হন। বাবা লালুপ্রসাদ যাদব ও মা রাবড়ী দেবীর ১৫ বছরের শাসনে যা ভুল হয়েছে, তার জন্য ক্ষমা চাইলেন রাষ্ট্রীয় জনতা দলের প্রধান তেজস্বী যাদব। বিরাট রাজনৈতিক চাল— সম্প্রতি পটনায় দলীয় কর্মীদের বৈঠকে বিহারের জনতার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি। সামনেই বিধানসভা নির্বাচন, তাই তাঁর পদক্ষেপ রাজনৈতিক ভাবে আরও বেশি মূল্যবান। সময়ের এই বোধ তাঁর রাজনীতির জমিকে পোক্ত করল।

Advertisement

কৌশলগত ভাবে তাঁর বিবৃতিটির দু’টি ভাগ। এক, তাঁর বাবা-মায়ের ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা। দুই, তিনি নিজেকে এমন এক নেতা হিসেবে দেখালেন, যিনি পরিবর্তনে বিশ্বাসী এবং বিহারের মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ইচ্ছুক। রাজনৈতিক ভাবে তেজস্বী যাদবের এই পদক্ষেপ দেখলে মনে হয়, যারা লালু-রাবড়ী আমলকে অন্ধকার যুগ হিসেবে দেখে, প্রাথমিক ভাবে বিহারের সেই উচ্চবর্ণ সমাজের ক্ষোভ প্রশমন করার চেষ্টা হয়েছে। সেই আমল নিয়ে তাদের অভিযোগের শেষ নেই। বস্তুত, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে তেজস্বী বুঝেছেন যে বিহারে জয় হাসিল করতে গেলে দলের সামাজিক ভিত প্রসারিত করতে হবে, যা এখনও যাদব, মুসলিমদের একাংশ এবং অতি-প্রান্তবর্তী দলিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যে উচ্চবর্ণ সমাজকে সামনে দেখা যায় এবং যারা মতামত তৈরি করে, তাদের বেশির ভাগই বিজেপির পক্ষে এবং নীতীশ কুমারের এনডিএ সরকারের সমর্থক। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই অংশের জনতা আরজেডি-র কাছে রাজনৈতিক ভাবে জরুরি। এর অন্তত একটি অংশকে কাছে টানতে উদ‌্গ্রীব তেজস্বী। তাতে বিজেপির ভোটভিত্তিতে ফাটল ধরবে। গত কয়েক সপ্তাহে উচ্চবর্ণের কিছু প্রভাবশালী নেতার দলে যোগদানের ব্যবস্থা করেছেন তেজস্বী। তাতে রঘুবংশ প্রসাদ সিংহের মতো লালুপ্রসাদ জমানার গুরুত্বপূর্ণ নেতারা আপত্তি তুলেছেন। এই ‘ক্ষমা চাওয়ার রাজনীতি’ সেই অভিমুখেই আর একটা ধাপ— বিহারের উচ্চবর্ণ সামাজিক ভিতে ছাপ ফেলার চেষ্টা। দ্বিতীয়ত, তাঁর এই পদক্ষেপ শহুরে মধ্যবিত্তকেও খুশি করতে পারে, যেখানে ওবিসি এবং দলিতদের একাংশ উচ্চবর্ণের সঙ্গেই ছোট-বড় শহর বা গঞ্জ এলাকায় বাস করে।

এই মধ্যবিত্ত মন, যারা আরামদায়ক জীবনের স্বপ্ন দেখে, তাদেরও লালু-রাবড়ীর রাজ্য শাসন নিয়ে প্রচুর অভিযোগ ছিল। বিহারে এনডিএ-র স্লোগান: ‘১৫ বনাম ১৫’ (অর্থাৎ লালু-রাবড়ীর ১৫ বছর এবং নীতীশ কুমারের ১৫ বছর)। তার পাল্টা দিতেই সম্ভবত তেজস্বীর এমন কৌশলী অবস্থান। একটা ব্যাপার তেজস্বীর নেতৃত্বাধীন আরজেডি-র পক্ষে যেতেই পারে। তা হল, বিহারে এখন একটা নবীন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যাদের লালু-রাবড়ী জমানা নিয়ে সরাসরি কোনও অভিজ্ঞতা নেই। তারা বাবা-মা অথবা পাড়াপড়শির কাছে এ ব্যাপারে শুনেছে। তারাও হয়তো তেজস্বীর মন্তব্যে খুশি। তাঁর নেতৃত্বে বিশ্বাসও রাখতে পারে।

Advertisement

আরও পড়ুন: চটজলদি গবেষণাপত্র ছাপানোর প্রবণতা মস্ত বিপদ ডাকছে

তেজস্বীর মন্তব্যের দ্বিতীয় ভাগ বিহারে আমূল বদলের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং জনতার আশা পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রমের কথা বলে। বক্তব্যের এই অংশটি তেজস্বীর নিজস্ব রাজনীতির জন্য বিশ্বাসের পুঁজি তৈরির প্রচেষ্টা। এই কথা বর্ণ, জাতপাত, গোষ্ঠী নির্বিশেষে বিহারের সমস্ত জনতার উদ্দেশে বলা। আমরা জানি, বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে নতুন স্বপ্ন-দেখা শ্রেণি বহু দিন ধরেই নীতীশের রাজনীতির সমর্থক এবং তাঁর শাসনের পক্ষে। এই শ্রেণিকেই নিজের দিকে টানতে চান তেজস্বী। সে জন্যই, এক দিকে তিনি নিজেকে ও দলকে লালু-রাবড়ীর শাসনের ছায়া থেকে বার করে আনতে চাইছেন, অন্য দিকে নিজস্ব রাজনীতির জন্য নতুন ভাবমূর্তি ও ধারণা তৈরির চেষ্টা করছেন, যা সবাইকে আশা, সমতা, সম্মান ও উন্নয়নের দিশা দেখাতে পারে। মজার কথা, নতুন ভাবমূর্তি গঠনের প্রক্রিয়াতেও তিনি লালু-রাবড়ীর নেতৃত্বাধীন আরজেডি-র পুরনো সদর্থক ছবিটাই নতুন রাজনৈতিক সম্পদ হিসেবে পুনর্গঠন করার চেষ্টা করছেন। দলিত এবং ওবিসি সামাজিক ভিত্তি তিনি ধরে রাখতে চান, যাঁরা বিহারে সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে লালুর অবদান স্মরণ করেন। তাঁদেরকেই সেই সব গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চাইছেন, যাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে লিপ্ত।

এটা ঠিকই যে ভারতীয় মনে ক্ষমা প্রার্থনা ব্যাপারটা ভাল কাজ করে। কিন্তু তা কী ভাবে উচ্চবর্ণ এবং অন্যান্যদের রাগ কমায়, সেটাও দেখতে হবে। কেননা, সমাজের এই অংশ নিজেদের লালু-রাবড়ী জমানার শিকার বলে মনে করে। তাদের কাছে এই জমানা অনুন্নয়ন, হিংসা আর দুর্নীতির। এই ভাবমূর্তি বিহারের সমাজে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মৌখিক পরম্পরায় বাহিত হয়ে থাকে।

জি বি পন্ত সোশ্যাল সায়েন্স ইনস্টিটিউট

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement