করলা নদীর অগভীর খাত পেরোলেই চোখে পড়ে একটা গ্রাম। তার বেশি ভাগ বাড়িই অর্ধেক ভাঙা। কোনওটার জানলায় কাগজ আটকানো। কোনও বাড়ির টিনের ছাদ ভেদ করে গভীর রাতে শীতের ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে। এক কামরার ঘরের বাইরে একটা উনুন। শীতকালে রাতের সময় সেটাও প্রায় ভিজে যায়। একটা ছেঁড়া কাঁথা আছে আর একটা লেপ। সেটিতেও অগুনতি পটি লাগানো। এই দুই সম্বল দিয়ে ওঁদের ছ’জনের পরিবারের শীত কেটে যায়। সকালে উনুন জ্বালাতে গিয়ে দেখেন, উনুনটা শীতে ভিজে গিয়েছে, শুধু ধোঁয়া উঠছে।
প্রতিদিনের ঘটনা এটা। গল্প নয়। নির্মম বাস্তব। চা-বাগান সংলগ্ন পাড়াগুলোয় গেলে ঠিক এ রকমই ছবি ভেসে উঠবে। অনেকেরই আদি বাড়ি ঝাড়খণ্ডের রাজধানী শহরের খুব কাছাকাছি। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে, পেটের টানে ওঁদের বাপ-ঠাকুরদারা এসেছিলেন। উত্তরবঙ্গে। আনা হয়েছিল তাঁদের। নতুন চা বাগান তৈরি হচ্ছিল তখন। এখন আর মনে নেই তাঁদের, আদি ভিটেটা ঠিক কোথায়? তবু ওঁরা আজও গল্প করেন আগের প্রজন্মের।
শীত এলেই বন্ধ হয়ে যায় চা-বাগানের কাজ। অর্ধেকের বেশি শ্রমিককে বসিয়ে দেওয়া হয় তখন। চার-পাঁচ মাস ওঁদের দু’বেলার খাবারটাও হয়ে ওঠে অনিশ্চিত। এতগুলো মানুষ কোথায় যাবেন, কী করবেন, সে সবের দিশা পাওয়া তখন বড় দায়! কোনও কোনও পরিবারে দু’তিনজন এক সঙ্গে চা-বাগানে কাজ করেন। শীতের আবির্ভাব ওঁদের কাছে দুর্যোগের মতোই ভয়াবহ! কোনওক্রমে একজন সদস্য হয়তো অল্প মজুরির কাজ জুটিয়েও নেন। কিন্তু তাতে পরিবারের স্বাভাবিক গতি ধরে রাখা সম্ভব হয় না।
একটা কাঁচা রাস্তা, তার দু’দিকে ছোট ছোট টিনের বাড়ি। উত্তরবঙ্গের চা-বাগান সংলগ্ন পাড়াগুলোর মানচিত্রটা এ রকমই। বাড়ির ছোট-বড় সবাই মিলে এক সঙ্গে চা-পাতা তোলার কাজে লেগে পড়েন। পাড়ায় বা একটু দূরেই হয়তো সরকারি স্কুল আছে। কিন্তু দিনের শেষে একশো বা দেড়শো বা আরও কম টাকা মজুরিতে স্কুলশিক্ষার স্বপ্ন রূপকথা ছাড়া অন্য আর কী হতে পারে! এই মানুষগুলোর চাহিদা খুবই সামান্য। আর ওই সামান্যটুকু থেকেও ওঁরা বঞ্চিত।
ব্রিটিশ আমলের ইতিহাস নয়, এটা বর্তমানের ছবি। বছরে একবার-দু’বার কিছু সমাজসেবীর দল পাড়াগুলোয় আসেন পোশাক বিতরণ করতে। কখনও নতুন, কখনও-বা পুরনো। নতুন-পুরনো নিয়ে ওঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই। পোশাক হাতে পেয়ে অনাবিল হাসি ভেসে ওঠে ওঁদের মুখে। সে হাসি বোধ হয় ভোরের সূর্যকেও হার মানায়!
কিন্তু মাঝেমধ্যে পোশাক বিতরণ আর খাদ্য বিতরণ করে কি আদতে ওঁদের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে কোনও পরিবর্তন আসে? সহায়তার প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু এ সবের বাইরে দূরদর্শী পরিকল্পনার প্রয়োজন নেই? আজ থেকে ৫০ বছর আগেও ওঁদের জীবন যেমন ছিল, আজও প্রায় তেমনই রয়ে গিয়েছে! বেশির ভাগ মানুষের কাছে জমির দলিলটুকুও নেই। পাবেনই-বা কোথায়? তাঁরা তো বহু বছর আগে অন্য জায়গা থেকে এসে ফাঁকা জমিতে বসবাস শুরু করেছিলেন! গড়ে তুলেছিলেন পাড়া। নদীর বাঁকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওঁদের গ্রামের অবস্থানও বদলেছে।
মোড়ের চায়ের দোকানে যখন দেশের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা হয়, তখন তাঁরা সেখানে থাকেন না। কারণ, ওঁরা চা-বাগানে কাজ করলেও চা কিনে খাওয়ার বাড়তি পয়সা ওঁদের নেই। তা ছাড়া দেশের কোথায় কী হচ্ছে, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ ওঁদের নেই। জীবনসংগ্রামে লড়তে লড়তে ওঁরা ক্লান্ত। শীতের রাতে মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়া ওঁদের নিত্যদিনের অভ্যাস। তাই অভিযোগ সব শুকিয়ে গিয়েছে। নেশা করে সাময়িক ভাবে কষ্ট নিবারণের বৃথা চেষ্টা করেন ওঁরা! সময় কখনও প্রসন্ন হয়নি এই সরল মনের মানুষগুলির প্রতি। টিনের ছাওনি ফুটো হয়ে গেলে, ওঁরা নারকেলের পাতা দিয়ে ঢেকে দেন!
চা-বাগানকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের কথা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ হয়নি কিছু! চা-বাগানকে কেন্দ্র করে যদি পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয়, তা হলে হয়তো সত্যিই এই সব মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। সর্বোপরি দরকার শিক্ষার আলো। এঁদের একটা প্রজন্মকে শিক্ষিত করতে পারলেও চিত্রপটের পরিবর্তন ঘটতে পারে! কিন্তু শিক্ষা তো তখনই পৌঁছনো সম্ভব হবে, যখন ওঁদের একটা স্থায়ী, সুরক্ষিত জীবন দেওয়া যাবে! দশ বছরের বালক, যে তিন-চার দিন ধরে মুড়ি খেয়ে আছে, শীতের কনকনে ঠান্ডা সকালে যার পরিধান বলতে ছেঁড়া চাদর, তার হাতে সত্যিই বই তুলে দিয়ে লাভ হবে কি? আগে তো খাবার তুলে দেওয়া দরকার!
তবে, অঙ্ক সে ভালই বোঝে! বোঝে বলেই বলতে পারে, চাল কেনার জন্য তাদের আরও কত টাকার প্রয়োজন! কিন্তু সমাজ, ব্যবস্থা বোধ হয় ওদের গণিতটি বুঝতে কোথাও ভুল করছে!