বাড়িতে মায়ের কিংবা স্ত্রীর হাতে আনাজ জাতীয় বিভিন্ন তরকারি রান্না করা হলেও সেই তরকারি ছেড়ে মাছ কিংবা মাংসের দিকেই চোখ পড়ত বেশি। সেই কারণে তরকারি সরিয়ে রেখে মাছ কিংবা মাংস দিয়ে ভাত খাওয়া হয়ে যেত বেশির ভাগ দিন। সেই সময়ে হাতের কাছে সবজি-তরকারি থাকলেও তাকে দূরে সরিয়ে রেখে মাছ-মাংস জাতীয় লোভনীয় খাবার মুখের গ্রাসে টেনে আনা হত। অথচ, করোনা মহামারির জেরে খাদ্যের সঙ্কটে সেই আনাজই এখন চরম কাঙ্ক্ষিত। বর্তমানে ভিন্ রাজ্যে আটকে পড়া মানুষগুলোর আর্থিক, সামাজিক পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, তাঁরা দিনের পর দিন ত্রাণের ডাল-ভাত খেয়ে চলেছে। খাবারের পাতে সামান্য সবজির স্বাদের জন্য হাহাকার করছেন।
ফোনে এ কথা জানিয়েছেন মুম্বইয়ে আটকে থাকা এক শ্রমিক। ছোট্ট একটি বাচ্চা, স্ত্রী নিয়ে নদিয়ার মিন্টু দেবনাথ মুম্বইয়ে রয়েছেন। সেখানকার সংক্রমণের জেরে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে ঘর থেকে বেরতেই ভয় পাচ্ছেন তাঁরা। চালে-ডালে বসিয়ে দিন কোনও রকমে লকডাউন পর্বে পেট চালাচ্ছেন। একটু যে ভাতের সঙ্গে তরকারি খাবেন, সে উপায় নেই। তাঁর জিভ তরি-তরকারির স্বাদ ভুলতে বসেছে। বর্তমানে ভিন্ রাজ্যে আটকে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ। কেউ টানা দু-দিন ধরে খালি পেটে রয়েছেন। কেউ সামান্য বিস্কুট-জল খেয়ে বাড়ি ফেরার জন্য মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছে। মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, তেলঙ্গানা, পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ বিভিন্ন রাজ্যে আটকে রয়েছেন গরিব শ্রমিকেরা। ফিরতে চাইলেও ফিরতে পারছেন না নিজের রাজ্যে, নিজের জেলায়। চার দফার লকডাউনে তাঁরা কাজহারা, সঙ্গে সঞ্চয়ের টাকাও ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। যে সমস্ত ঠিকাদার মারফত তাঁরা ভিন্ রাজ্যে কাজের খোঁজে গিয়েছিেলেন, তাঁরাও পরিস্থিতির চাপে আর্থিক সমস্যায় ভুগছেন। ফলে, শ্রমিকদের সাহায্য করা বন্ধ করে দিয়েছেন। বড় বড় হোটেল-রেস্তরাঁ বন্ধ। এমনকি, বিল্ডিং তৈরির কাজও বন্ধ। মালিক পক্ষের হাতেও অর্থের জোগান নেই।
যদিও এই সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকের সমস্যা সেই সব ঠিকাদার বা হোটেল-রেস্তরাঁ মালিকদের চেয়ে হাজার গুণ বেশি। তাঁরা কোনও মতে বাড়ি ফিরে এলেও ভবিষ্যতে তাঁরা কী ভাবে রোজগার করবেন, কী ভাবে সংসারের খরচ চালাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। গত দু’ মাস ধরে চলা লকডাউনে তাঁদের কাজ বন্ধ। ফলে, বেতন পকেটে আসেনি। আগে যা এসেছিল, তার প্রায় ৭৫ শতাংশ পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছেন তাঁরা। মহামারি পরিস্থিতিতে পরিবারের হাতে দেওয়া সেই টাকাও ফুরিয়ে যাওয়ার দিকে। বাকি থাকল ২৫ শতাংশ। সেই অর্থ পরিযায়ী শ্রমিকেরা গত দুই মাসের লকডাউনে থাকা-খাওয়ার জায়গায় শেষ করে ফেলেছেন।
ভবিষ্যতে এই সব মানুষ কী খাবেন? সে ভাবার অবস্থায় পরিযায়ী শ্রমিকেরা বর্তমানে নেই, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আপাতত, তাঁদের মাথার উপর ছাদ আর পেটে খাবারের প্রয়োজন। সেই কারণেই বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছেন তাঁরা। এই মুহূর্তে তাঁদের জরুরি চাহিদা একটাই, তা হল— খাদ্য। ভিন্ রাজ্যে আটকে থাকা শ্রমিকেরা জানাচ্ছেন, জমানো টাকা যেটুকু ছিল, তা ফুরিয়েছে অনেক দিন আগেই। অন্য দিকে, বন্ধ রয়েছে সমস্ত নির্মাণকাজ। তবে সে কথা বাড়ির খুদে সদস্যদের কেমন করে বোঝাবেন শ্রমিকেরা? তাদের খিদের পেট ভরাবেন কী করে? বলছিলেন ভিন্ রাজ্যে আটকে থাকা এক শ্রমিক— ‘‘কাজ না করলে টাকা আসবে কী করে? যা ছিল তা তো গিয়েছে, কিন্তু পেট না চললে বাঁচব কী করে?’’ স্বাভাবিক ভাবেই মনের ভিতর নানা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। নিরুপায় শ্রমিকেরা ভাবছেন এর পর কোথায় খাবার পাবেন? কত দিন আর প্রশাসন তাঁদের সাহায্য করবে? কত দিন সমাজসেবী সংস্থার মানুষেরা তাঁদের পাশে দাঁড়াবেন? দ্বিতীয় ধাপের লকডাউন থেকেই তাঁদের সামনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে সঙ্কটের চেহারাটা। যেমন তেলঙ্গানায় আটকে থাকা নদিয়ার বেশ কিছু শ্রমিক জানাচ্ছেন তাঁদের দুরাবস্থার কথা। তাঁরা জানাচ্ছেন, প্রথম ধাপের লকডাউনে তেলঙ্গানা প্রশাসন প্রাথমিক ভাবে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দিয়েছিল তাঁদের। তা দিয়ে চলেছিল অনেক ক’টা দিন। তার পর শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের লকডাউন। তখন কিন্তু আর কিছু সাহায্য মেলেনি। হাত বাড়াতে হয়েছিল ত্রাণের খাবারের দিকে। তা দিয়ে চলেছে বেশ ক’দিন। কিছু দিন পর তাঁদেরও আর দেখা মেলেনি। বাধ্য হয়েই শ্রমিকদের তখন যেতে হয়েছিল তেলঙ্গানা কালেকটারিতে। সেখানকার অভিজ্ঞতা ভাল নয়। সেখানে উল্টে তাঁদের কথা শুনিয়েছিলেন কালেকটারির আধিকারিকেরা। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন— পশ্চিমবঙ্গ সরকার শ্রমিকদের সাহায্য করবেন, তাঁরা নন। এমন অবস্থায় খিদে-তেষ্টা নিয়ে কোথায় যাবেন অসহায় ওই শ্রমিকেরা? তখনই শুরু হয় বাড়ি যাওয়ার হিড়িক। পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিলেন ওঁরা। পুলিশের লাঠির বাড়ি, পথ দুর্ঘটনা কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে ওঁরা দলে দলে বেরিয়ে পড়েছেন রাস্তায়।
এর পরেই চাপে পড়ে শ্রমিকদের ফেরাতে চালু করা হল বিশেষ ট্রেন। কিন্তু কতজন ফিরলেন?
শুনে নেওয়া যাক, মহারাষ্ট্রের নাগপুরে আটকে থাকা নদিয়ার কিছু পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা। দুই মাসের বেশি কাজ বন্ধ, রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন নদিয়ার ওই ১০ শ্রমিক। কিছু টাকা অবশ্য হাতে ছিল। কিন্তু তা দিয়ে পেট চালানোর জন্য খাবার কিনতে হত। তা হলে ফেরার উপায় কী? নাগপুরের জয়ন্তী নগরের পঞ্চায়েতের কাছে গিয়ে ট্রেন কিংবা বাসে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থার কথা জানানো হয়। এর জন্য লিখিত দরখাস্ত দেওয়া হয় সেখানে। কিন্তু আজ-কাল-পরশু করেও ব্যবস্থা করে দিতে পারেনি প্রশাসন। এক দিকে পেটে খিদে, সংক্রমণের আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে তাঁদের। প্রশাসনের ব্যর্থতার কথা বুঝে এক দিন সকাল-সকাল হাঁটতে শুরু করলেন সেই শ্রমিকেরা। পথে লরির দেখা মিললেও কাকুতি-মিনতি করে কিছু কিলোমিটার পথ লরিতে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু তার পর আবার হাঁটা শুরু। ছয় দিন পর তাঁরা পৌঁছন পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের ওড়িশার রাধাবল্লভপুর। ব্যাগে কিছু প্যাকেট বিস্কুট ছিল। ওইটুকু সম্ভল নিয়েই মাইলের পর মাইল পথ হেঁটেছেন শ্রমিকেরা। অবিরাম হাঁটার ফলে পায়ে ফোস্কা পড়ে যায়। কিন্তু হাঁটা থামাননি ওঁরা। বাড়ি ফেরার তাগিদে ‘আত্মনির্ভর’ হয়ে লড়ে গিয়েছেন।
এই পরিযায়ী শ্রমিকেরাই দেশীয় অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। এঁরাই দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। অথচ, এঁদের সমস্যা নিয়ে ভাবার মতো কেউ নেই। এঁদের জিভে হারিয়ে যাওয়া আনাজের স্বাদ কিংবা পায়ের নীচে ছুঁলে যাওয়া চামড়া— সেই ব্যবস্থাকেই ক্রমশ দুর্বল করে তুলছে, যেন ভুলে না যাই।