Patriarchy

পুরুষতন্ত্রের শাসন

যুক্তি উঠিবে, ভারতে যখন গর্ভ ভাড়া দেওয়া আইনসিদ্ধ ছিল, তখনও কি কাশ্মীরা বিবির ন্যায় মহিলাদের স্বাধীনতা ছিল ভাড়া দেওয়া অথবা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২০ ০০:০১
Share:

কাশ্মীরা বিবি প্রমাণ করিলেন, বাজারকে বুঝিবার সাধ্য রাষ্ট্রের নাই। তিনি পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র মহিলা। আট লক্ষ টাকার বিনিময়ে গর্ভ ভাড়া দিয়াছিলেন। অর্ধেক টাকা হাতে পাইবার পর তিনি হঠাৎই উধাও হইয়া যান, এবং শেষ অবধি জানা যায়, তিনি এক হাতুড়ের নিকট গর্ভপাত করাইয়াছেন। তাঁহার ‘অপরাধ’ যে দিন ধরা পড়িল, তাহার অব্যবহিত পূর্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সারোগেসি (নিয়ন্ত্রণ) বিল, ২০২০-তে সম্মতি জানাইল। সংসদে যখন প্রথম বিলটি পেশ করা হইয়াছিল, তাহাতে প্রচুর কাটছাঁট হইয়াছে, নূতন কথা জুড়িয়াছে। কিন্তু, তাহার মধ্যে সেই কথাটি নাই যাহা কাশ্মীরা বিবিকে এই সঙ্কট হইতে বাঁচাইতে পারিত। ভারতভাগ্যবিধাতারা কিছুতেই সারোগেসির বাজার খুলিয়া দিতে সম্মত হন নাই। আত্মীয়পরিজন ব্যতীত কেহ যে গর্ভ ধার দিতে পারিবেন না, এই কথাটি বিলে জ্বলজ্বল করিতেছে।

Advertisement

যুক্তি উঠিবে, ভারতে যখন গর্ভ ভাড়া দেওয়া আইনসিদ্ধ ছিল, তখনও কি কাশ্মীরা বিবির ন্যায় মহিলাদের স্বাধীনতা ছিল ভাড়া দেওয়া অথবা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের? তখনও কি বহুলাংশে পুরুষেরাই সেই সিদ্ধান্ত করিত না? কথাটি অনস্বীকার্য, এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনিবার্য। কিন্তু, স্নানের জলের সঙ্গে শিশুকেও ফেলিয়া দেওয়ার রাষ্ট্রীয় কু-অভ্যাসটি মহিলাদের উপকার করিতেছে না। ভাড়া দেওয়ার অবকাশই যদি না থাকে, সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা অর্জনের প্রশ্নটিও অবান্তর হইয়া যায়। গর্ভ ভাড়া দেওয়া বিষয়ে সরকারের সুদৃঢ় আপত্তির কারণটিও গভীর ভাবে পুরুষতান্ত্রিক— নারীর শরীরের উপর নারীর নিজস্ব এজেন্সি স্বীকার করিতে সরকার নারাজ। পুরুষতন্ত্রের চোখে নারী নিতান্তই সম্পত্তি— স্বামীর, এবং পরিবারের। সারোগেসি বিলও ঘোরতর ভাবে সেই যুক্তিতে প্রোথিত। অতএব, বাজারকে নারী হইতে এবং নারীকে বাজার হইতে দূরে রাখিবার আইনি ব্যবস্থা হইয়াছে।

কমার্শিয়াল সারোগেসির বাজার খুলিয়া দিলেই কি কাশ্মীরা বিবিদের সুবিধা হইত? উত্তরটি একমাত্রিক নহে। প্রথমত, বাজার খুলিয়া দেওয়ার প্রকৃত অর্থ, লেনদেনকে আইনসঙ্গত করিয়া তোলা, এবং তাহা যাহাতে সর্বার্থেই আইনসম্মত হয়, তাহা নিশ্চিত করা, সেই পরিকাঠামো তৈরি করিয়া দেওয়া। অর্থাৎ, রাষ্ট্র যদি সারোগেসির একটি প্রকৃত বাজারের কথা ভাবিত, তাহা হইলে কাশ্মীরা বিবিরা একেবারে গোড়া হইতে নিজেদের অধিকার এবং দায়িত্বের কথা জানিতেন। অধিকার ক্ষুণ্ণ হইলে কী ভাবে তাহার সুরাহা করা সম্ভব, এবং দায়িত্বে অবহেলা করিলে কী শাস্তি হইতে পারে, উভয় বিষয়েই তাঁহাদের স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রকৃত বাজারের পূর্বশর্ত। ফলে, চুক্তির মধ্যপথে, ২৬ সপ্তাহের মাথায়, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত তাঁহারা লইতেন না বলিয়াই আশা। দ্বিতীয়ত, বাজারটিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিলে সমাজের ধারণাও ক্রমে বদলাইত, যে ভাবে কর্মরত মহিলাদের বিষয়েও সমাজের মন বদলাইয়াছে। ‘সমাজের চাপে’ চুক্তিভঙ্গ করিবার পরিস্থিতি তৈরি হইত না। তৃতীয়ত, গর্ভপাতের প্রয়োজন হইলেও হাতুড়ের ডাক পড়িত না, ফলে প্রসূতির স্বাস্থ্যরক্ষা হইত। ভারতের কর্তাদের নিকট এই কথাগুলির তুলনায় ‘পরিবারের সম্মান’ অধিকতর গুরুত্ব পাইয়াছে। বাণিজ্যিক সারোগেসি থাকিবে বটে, কিন্তু কালো বাজারের আড়ালে। কাশ্মীরাদের বিপন্নতা বাড়িবে বই কমিবে না।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement