দুর্ভাগা সেই দেশ, যেখানে নিতান্ত সাধারণ একটি কথাও ব্যতিক্রমী মানসিকতার উদাহরণ হিসাবে বিবেচিত হয়, প্রতিস্পর্ধার নজির হইয়া উঠে। জ়োম্যাটো নামক অনলাইন খাদ্য সরবরাহ সংস্থা, ও তাহার কর্ণধার দীপিন্দ্র গয়ালের টুইট তেমনই মর্যাদা পাইতেছে। টুইটের কথাগুলি নিতান্ত সাধারণ— ‘খাদ্যের কোনও ধর্ম হয় না, খাদ্য নিজেই একটি ধর্ম’। বস্তুত, তাঁহার কথাগুলি নহে, যে পরিস্থিতিতে তাঁহার এই সাধারণ কথাগুলিও অসাধারণ হইয়া উঠিয়াছে, সেই পরিস্থিতিটিই অ-সাধারণ। আপাত ভাবে তাহার কেন্দ্রীয় চরিত্র অমিত শুক্ল নামক জবলপুরের এক বাসিন্দা। ধর্মে মুসলমান এক ডেলিভারি বয়ের হাত হইতে খাবার লইতে অস্বীকার করিয়া, এবং জ়োম্যাটো ডেলিভারি বয় পাল্টাইতে রাজি না হওয়ায় নিজের ক্ষোভের কথাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় চাউর করিয়া অমিত শুক্ল সংবাদ শিরোনামে। তাঁহার নিকৃষ্ট মানসিকতার বিপ্রতীপেই দীপিন্দ্র গয়ালের কথাগুলিকে ভারত নামক দেশটির মূলগত দর্শনের ব্যতিক্রমী প্রতিফলন বোধ হইতেছে। কিন্তু, শুধুই কি অমিত শুক্লের কারণে? সোশ্যাল মিডিয়ার হরেক প্ল্যাটফর্মে যাঁহারা অমিতের সমর্থনে রকম-বেরকমের কুযুক্তি আমদানি করিতেছেন, তাঁহারাও কি সেই একই অন্ধকারের শরিক নহেন? অথবা, এই সময়টিই কি আখ্যানের মূল খলনায়ক নহে, যাহা এই গোত্রের অসহিষ্ণুতা, নিকৃষ্ট মানসিকতাকে এক ধরনের সামাজিক মান্যতা দিয়াছে? কোনও মুসলমানের হাতের খাবার খাইব না, এই কথাটি যদি মনের গহনতম প্রান্তে থাকিতও, কয়েক বৎসর পূর্বেও ভারতে জনসমক্ষে এই কথাটি বলিবার সাহস সচরাচর দেখা যাইত না। এমন ইতর কথা লোকসমাজে বলা যায় না, এ হেন একটি বিশ্বাস নেহরু-পর্বের ভারতে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সেই বিশ্বাসকে এই সময় স্বচ্ছ গঙ্গার জলে ভাসাইয়া দিয়াছে। অমিত শুক্লরা যত প্রকট হইয়া উঠিতেছেন, দীপিন্দ্র গয়ালদের অবস্থান ততই বিরল, ততই অলীক এবং তীব্র ব্যতিক্রমী হইয়া উঠিতেছে। অশিক্ষার স্বর্গে ভারত জাগরিত হইয়াছে।
অমিত শুক্ল বা তাঁহার সমর্থকরা জানিতে চাহিতে পারেন, কাহার আনিয়া দেওয়া খাবার খাইব না, তাহা কি নিতান্তই ব্যক্তিগত পরিসরের প্রশ্ন নহে? ধর্মীয় বিশ্বাসের বাধা অতিক্রম করিয়া মুসলমানের আনিয়া দেওয়া খাবার খাইতে দেশের কোন আইন আমায় বাধ্য করিতে পারে? এই প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া কঠিন, এবং সম্ভবত সেই কারণেই, সামাজিক ও ধর্মীয় সংহতি নষ্ট হইতে পারে, এমন কোনও কাজ ভবিষ্যতে করিবেন না, এই মর্মে অমিত শুক্লের নিকট মুচলেকা চাহিয়াছে পুলিশ। প্রশ্নটি অবশ্য আইনের নহে, সামাজিক শিষ্টতার। কেহ মুসলমান বলিয়া তাঁহার সহিত এমন অসহনীয় আচরণ করা সামাজিক শিষ্টতার পরিপন্থী। কোনও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে এ হেন আচরণ অগ্রহণযোগ্য। এবং, সেখানেই এই সময়টির মাহাত্ম্য। এই সময় ভারতবর্ষকে শিখাইয়াছে, শিষ্টতা, সহিষ্ণুতার ন্যায় বায়বীয় ধারণার কোনও গুরুত্বই নাই— যে কোনও সময় সেই গণ্ডি উল্লঙ্ঘন করা চলিতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি আসিয়া ধর্মনিরপেক্ষতাকে লইয়া গিয়াছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই প্রশ্ন করিতেছেন, খাদ্যের যদি ধর্ম না থাকে, তবে ‘হালাল খাদ্য’ পৃথক ভাবে চিহ্নিত করা থাকে কেন? অর্থাৎ, জ়োম্যাটোর অবস্থানটি নিতান্ত দ্বিচারিতা, মুসলমান তোষণ। সংখ্যাগুরুবাদের এমনই জোর যে তাঁহারা ভুলিয়াছেন, সেই একই অ্যাপে নিরামিষ খাদ্য, জৈন খাদ্য (অর্থাৎ পেঁয়াজ-রসুনহীন রান্না), এমনকি নবরাত্রের বিশেষ খাদ্যও আলাদা ভাবে চিহ্নিত থাকে। কাহার আনিয়া দেওয়া খাবার খাইব না, আর কোন খাবার খাইব না— এই দুইটি প্রশ্ন যে চরিত্রগত ভাবে পৃথক, তাহা স্মরণে রাখিবার দায় এই সময় আর রাখে নাই। ফলে, অমিত শুক্লরাই মূলস্রোত। দীপিন্দ্র গয়াল ব্যতিক্রমী।