ছবি: সংগৃহীত।
শতাব্দীপ্রাচীন দুইটি আন্তর্জাতিক পর্যটন পরিষেবা সংস্থার বন্ধ হইবার সংবাদে বিশ্ব আলোড়িত। একটি সংস্থা দেড়শত বৎসরেরও বেশি সময় ধরিয়া বিশ্বের নানান প্রান্তে পর্যটকদিগের ভ্রমণের যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করিয়া আসিতেছিল। অন্যটি ততোধিক পুরাতন, সদর দফতর ভারতে। এমন নহে যে অকস্মাৎ কিছু ঘটিয়াছে। সংস্থাগুলির পরিষেবা লইয়া অপ্রীতিকর অভিযোগ আসে নাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কি ব্যবসায়িক দুর্ঘটনাও ঘটে নাই। তথাপি প্রথমটির ব্যবসা বন্ধ হইবার খবরে পৃথিবীর নানান প্রান্তে দেড় লক্ষ পর্যটক আটকাইয়া পড়িলেন, পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ কোনও না কোনও রূপ অসুবিধার সম্মুখীন। যে সংস্থার নিজস্ব বিমান বিশেষ গর্বের বস্তু ছিল, তাহাই এখন দেউলিয়া ঘোষণা করিয়া হাত তুলিয়া দিয়াছে। অন্যের বিমান ধার করিয়া শতসহস্র পর্যটককে দেশে ফিরাইয়া আনিবার বন্দোবস্ত হইতেছে।
এমন কী হইল যাহাতে সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ এক সংস্থারও ঝাঁপ পড়িয়া গেল? বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, দোষ সংস্থার নয়, বদলাইয়া গিয়াছে বাজার। আবার দোষ নাই বলিলে ভুল হইবে, পরিবর্তিত বাজার-চাহিদার সঙ্গে তাল মিলাইতে না পারা নিঃসন্দেহে একটি ব্যবসায়িক সংস্থার ত্রুটি। গত এক দশকে পর্যটন পরিষেবার ক্ষেত্রটি আমূল বদলাইয়া গিয়াছে। প্রযুক্তি, বিশেষত আন্তর্জালের সাহায্যে ঘরে বসিয়া যে কেহ দেশে বা বিদেশে ঘুরিয়া আসিবার যাবতীয় ব্যবস্থা করিয়া ফেলিতে পারেন। তাহার জন্য কোনও ভ্রমণ সংস্থার মুখাপেক্ষী হইতে হয় না। পর্যটন তবু মানুষের সাময়িক চিত্তবিনোদনের মাধ্যম, হয়তো বৎসরে এক-দুই বার ঘটিয়া থাকে। দৈনন্দিন জীবনযাপনের সহিত যে পণ্য বা পরিষেবাগুলি জড়াইয়া আছে, তাহাদের ক্রয়বিক্রয় তথা উপভোগের পরিসরটিও আজ বিলক্ষণ ভোল পাল্টাইয়াছে। এক স্মার্টফোন আসিয়াই একাধারে ক্যামেরা, সিডি ও ডিভিডি প্লেয়ার, ঘড়ি, ডাকবাক্স, পুস্তক, চিত্রগৃহকে আত্মসাৎ করিয়াছে। আগে উৎসবের পূর্বে মানুষ বাজার ঘুরিয়া নূতন পোশাক কিনিত, এখন ডিজিটাল বোতাম চাপিয়া বরাত দিলে নূতন বস্ত্র এমনকি অলঙ্কারও ঘরে আসিয়া উপস্থিত হয়। এক ছাদের তলায় একদা আলপিন হইতে আলমারি পর্যন্ত মিলিবে, কে ভাবিয়াছিল? সুপারস্টোর ও শপিং মল তাহা সম্ভব করিয়াছে। মুদি হইতে খুচরা ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র বিপণি বা পরিষেবা সংস্থাগুলি বাঁচিল কি মরিল, কাহারই বা দেখিবার সময় রহিয়াছে?
অপ্রিয় হইলেও সত্য, অর্থব্যবস্থার ইহাই দস্তুর। সতত পাল্টাইয়া যাওয়াই বাজারের চরিত্র। আজ যাহা অপরিহার্য বলিয়া মনে হইবে, কালক্ষেপে তাহাই ভূলুণ্ঠিত হইতে পারে। জীবনযাপনের ক্রমোৎকর্ষের সহিত নাগরিক উপভোক্তার রুচির বদল হইবে, তাহা প্রভাবিত করিবে চাহিদাকে, আধুনিক প্রযুক্তির সহিত গাঁটছড়া বাঁধিয়া সেই চাহিদা খুঁজিয়া লইবে নূতনতর ও আশু ফলপ্রদ সরবরাহ ব্যবস্থাটিকে। এই সমগ্র ও নিরবচ্ছিন্ন সূত্রটির কোনও অংশের সহিত বিক্রেতা বা পরিষেবা-প্রদানকারী তাল মিলাইতে না পারিলেই মুশকিল। সার্ধশতবর্ষ অতিক্রান্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে ইতিহাস ধন্য ধন্য করিতে পারে, বাজার কদাপি করে না। তাহা অতীতচারী নহে, বাস্তবে পা রাখিয়া বরং ভবিষ্যতের দিকে চাহিয়া আছে। কেহ পিছাইয়া পড়িলে সে ফিরিয়াও তাকাইবে না। পরিবর্তনই তাহার নিকট একমাত্র ধ্রুবক।