—প্রতীকী চিত্র।
যুক্তি এবং বিজ্ঞান যেখানে পৌঁছাইতে পারে না, সেখানে অন্ধকারই সার। এই অন্ধকারের ব্যাপ্তি কত দূর? বহু দূর— একযোগে বলিতেছে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি। এক কালে অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কার প্রান্তিক বিষয় বলিয়া প্রতিপন্ন হইলেও, ক্রমশ সেই বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটিতেছে। ডাইনি অপবাদ, ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, জলপড়া-তেলপড়া, ওঝা, গুনিনদের কারবার ক্রমশ সমাজের মূলস্রোতে মিশিতেছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতেই যেমন ভিটাছাড়া হইয়াছেন এক দম্পতি। ডাইনি অপবাদ দিয়া গ্রামবাসীরা তাঁহাদের চার মাস পূর্বে উৎখাত করিয়াছে। বন্ধ হইয়াছে দুই পুত্রের পড়াশোনা। ফিরিবার চেষ্টা করিলে মিলিতেছে প্রাণনাশের হুমকি। কিছু দিন পূর্বে অনুপ সর্দারের মৃত্যু তো হইয়াছে কলিকাতার প্রায় দোরগোড়ায়, দেগঙ্গাতে। অর্থাভাবে কলিকাতার হাসপাতালে তাঁহাকে লইয়া আসা যায় নাই। গুনিনের শরণাপন্ন হইয়াছিল পরিবার। গুনিনরা ‘জিন’ তাড়াইতে পারে নাই। অনুপও বাঁচেন নাই।
একবিংশ শতকেও চিন্তাভাবনার এমন ভয়ঙ্কর পশ্চাদগামিতা! ভারতীয় বিজ্ঞানের চন্দ্রযাত্রার মুহূর্তেও বশীকরণ, তন্ত্রসাধনার বিজ্ঞাপনগুলি শুধুমাত্র প্রত্যন্ত গ্রামে নহে, খাস কলিকাতার রাজপথে চোখে পড়ে। অথচ দুই-তিন দশক পূর্বেও বিজ্ঞানচেতনা প্রসারের এক তাগিদ চোখে পড়িত। মফস্সলের স্কুলগুলিতেও আয়োজিত হইত বিজ্ঞান মেলা। অংশ লইত বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যেরা বিভিন্ন সভায় প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝাইয়া দিতেন ছোট ছোট ঘটনার পশ্চাতে বৈজ্ঞানিক যুক্তি। ‘বাবা’ নামধারীদের রকমারি কারসাজির সত্যও উদ্ঘাটিত হইত তাঁহাদেরই হাত ধরিয়া। বিজ্ঞানকে তখন দৈনন্দিনতায় মিশাইয়া দিবার এক উদ্যোগ চোখে পড়িত। দুর্ভাগ্য, সেই উদ্যোগ ক্রমশ ম্লান হইতেছে। আলোকিত হইবার বদলে সমাজ আঁকড়াইয়া ধরিতেছে চিন্তার স্থবিরতাকে। অস্বাভাবিক নহে। নূতন ভারতে ধর্মীয় প্রাধান্যবাদের প্রতিষ্ঠা ও যুক্তির পথ বর্জনের ঘটনা পরস্পরের পরিপূরকই বটে। কিন্তু ধর্ম মানুষকে রক্ষা করিতে শিখায়, নির্যাতন করিতে নহে। ধর্মের কারবারিরা কি জানেন না, ঝাড়ফুঁকে রোগ সারে না, তাহার জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন? ধর্মের সংস্কার আর কুসংস্কার এক বস্তু নহে। রাজনীতির প্রয়োজনে ধর্মীয় মোড়কে কুসংস্কারগুলিকে প্রশ্রয় দিবার বদলে, সত্যটুকু যাঁহারা মানুষের কাছে পৌঁছাইয়া দেন, তাঁহাদের অধার্মিক বলা যায় না। তাঁহারাই প্রকৃত ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন।
একেবারে গোড়ার কথা, প্রশাসন কঠোর হউক। অন্ধবিশ্বাসের মানুষের এ-হেন বিপুল দুর্ভোগের জন্য দায়ী প্রশাসনই। ধর্মীয় প্রতাপের সম্মুখে সরকার নতজানু বলিয়াই এখনও ডাইনি সন্দেহে মৃত্যুর ঘটনা ঘটিতেছে। অন্ধবিশ্বাসের এই নির্যাতন রোধ করিতে প্রয়োজন প্রশাসনিক উদ্যোগে সচেতনতা বৃদ্ধির। বহু অ-সরকারি সংস্থাও স্ব-উদ্যোগে বিজ্ঞানচেতনা প্রসারের কাজ করে, কিন্তু অর্থাভাব প্রকট। সরকারের উচিত তাহাদেরও সাহায্য করা। সর্বোপরি প্রয়োজন, অন্যায় দমনে প্রশাসনিক সংগঠনকে কাজে লাগানো। ডাইনি অপবাদে হত্যার একটি অভিযোগ পাইলেও যেন সেই অঞ্চলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্তাদের জবাবদিহির মুখে পড়িতে হয়, ধর্মনির্বিশেষে অপরাধীরা যেন কড়া এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়।