—ফাইল চিত্র।
দিল্লি যখন জ্বলিতেছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তখন উপহার ভাবিতেছিলেন। নারী দিবসের উপহার। নারী দিবসের ধারণাটিকে নাগপুর এখনও কেন পশ্চিমি অপসংস্কৃতি বলিয়া দাগাইয়া দেয় নাই, তাহা এক রহস্য। ইহা ভ্যালেন্টাইনস ডে নহে, প্রেমের সহিত নারী দিবসের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নাই, ফলে নরেন্দ্র মোদী নির্দ্বিধায় উপহার দিতে পারেন। শেষে স্থির করিলেন, ৮ মার্চ একটি দিনের জন্য তিনি নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলি তুলিয়া দিবেন নারীদের হাতে। তেমন ভক্তেরা বলিবেন, কর্ণ নিজের কবচকুণ্ডল খুলিয়া দিয়াছিলেন— এই উপহার তাহার অপেক্ষাও মহৎ। ভারতে সোশ্যাল মিডিয়ার আদিলগ্ন হইতে নরেন্দ্র মোদী তাহাকে সুনিপুণ ভাবে ব্যবহার করিয়াছেন। তাঁহার প্রতিটি অর্ধসত্য সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মুহূর্তে পৌঁছাইয়াছে কোটি কোটি ভক্তের স্মার্টফোনে। সোশ্যাল মিডিয়া ছিল বলিয়াই তিনি মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে হেলায় অবজ্ঞা করিয়াছেন। সেই অত্যাগসহন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট তিনি দেশের নারীদের হাতে তুলিয়া দিবেন, ভাবিলেও শিহরন জাগে। তবে, এই প্রসঙ্গে একটি কথা না বলিলেই নহে। বিবিধ দফায় কামান দাগিয়া দেশের জনমানসে তিনি বা তাঁহারা এমনই ভীতির সঞ্চার করিয়াছেন যে তাঁহার সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়িবার ‘টিজ়ার’-টি বাজারে পড়ামাত্র লোকে ভাবিয়া আকুল— তবে কি দেশে সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ হইতে চলিয়াছে? অথবা, নোট বাতিলের পর যেমন পেটিএম-এর বিজ্ঞাপনে হাস্যমুখ নরেন্দ্র মোদীকে দেখা গিয়াছিল, কোনও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মেরও কি তেমন কপাল খুলিবে? গোটা দেশকে এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের তারে বাঁধিয়া ফেলা মুখের কথা নহে।
প্রশ্ন হইল, উপহার হিসাবে এই এক দিনের মালিকানা কেমন? আপাতদৃষ্টিতে মনে হইবে, তুচ্ছ। লিপ ইয়ার বাবদ যে বাড়তি দিনটি পাওয়া গিয়াছিল— এ প্লাস বি হোল স্কোয়্যারের ফর্মুলায় ‘বাড়তি টুএবি’-র ন্যায়— তাহাকে নিজের বিপণনের কাজে ব্যবহার করিবার চেষ্টা বই কিছু নহে। কিন্তু, তলাইয়া ভাবিলে এই উপহারের মাহাত্ম্য দৃশ্যমান হইবে। ইতিপূর্বে নরেন্দ্র মোদী ভারতীয় মহিলাদের জন্য কয়েকটি উপহারের ব্যবস্থা করিয়াছেন। যেমন, সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন, প্রভিডেন্ট ফান্ডে পুরুষদের বেতনের ১২ শতাংশ জমাইতে হইলেও মহিলাদের মাত্র ৮ শতাংশ জমাইলেই চলিবে। বাকি চার শতাংশ কি তবে সরকার দিবে? না, ততখানি জোরালো উপহার নহে। ফলে, মেয়েদের সঞ্চয়ের পরিমাণ কমিয়া গেল। তাঁহাদের ক্ষমতায়নও আর এক ধাপ পিছাইল। মোদী ঘরে ঘরে এলপিজি পৌঁছাইবেন বলিয়া ঘোষণা করিলেন— তাহাতে নাকি মহিলাদের সম্মান বাড়িবে। বহু গৃহস্থালিতেই এখন এই প্রতিশ্রুতিটির ন্যায় অন্তঃসারশূন্য সিলিন্ডার বিরাজমান— হয় সিলিন্ডার কিনিবার পয়সা নাই, নচেৎ তাহার জোগান নাই। মহিলারা যথাপূর্বং জৈবজ্বালানি ব্যবহার করিতেছেন। প্রধানমন্ত্রীর আর এক উপহার ‘বেটি বচাও, বেটি পঢ়াও’-এর এক বিজ্ঞাপনে লেখা হইয়াছিল, মেয়েদের বাঁচাইয়া না রাখিলে তোমায় রুটি বানাইয়া দিবে কে? অর্থাৎ, মেয়েরা যদি বা বাঁচে, তবে পরিচিত লিঙ্গ-ছকেই বাঁচিতে হইবে। নারীর নিরাপত্তা, ক্ষমতায়ন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি বিষয়ক উপহারগুলির কথা উহ্যই থাকিল। ভাবিয়া দেখিলে, এই উপহারগুলির তুলনায় এক দিনের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার মালিকানার উপহারটি কি নিতান্ত নির্বিষ নহে?