ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব যে ক্রমশ বাড়ছে, তা নীতিনির্ধারকদের অজানা থাকার কথা নয়। ডেঙ্গির প্রকৃত প্রকোপের মাত্রা সরকারি পরিসংখ্যান থেকে সম্পূর্ণ ধরতে পারা না গেলেও, ডেঙ্গি বৃদ্ধি বা হ্রাসের প্রবণতা সরকারি পরিসংখ্যান থেকে খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারা যায়। এই লেখার প্রথম পর্বে (‘জনস্বাস্থ্যকে অবহেলা...’, ১৪-১১) প্রকাশিত রেখচিত্রটি থেকে আমরা দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গে ২০০৫ সাল থেকে ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। ভারতের সামগ্রিক ছবিটাও এর কাছাকাছি— ২০০৩ সাল থেকে দেশে ডেঙ্গির প্রকোপ বেড়েছে। তার আগে ১৯৯৬ সালে দিল্লিতে দেখা গিয়েছিল ডেঙ্গির ভয়াবহ রূপ, আক্রান্ত হয়েছিলেন ১০২৫২ জন এবং ৪২৩ জন মারা গিয়েছিলেন। সে বছর সারা ভারতে ডেঙ্গিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৬৫১৭, মৃতের সংখ্যা ছিল ৫৪৫।
পশ্চিমবঙ্গেও মনে রাখার মতো ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬৩ সালে, কলকাতায়। সেটা ছিল ভারতে প্রথম ডেঙ্গির বড় আক্রমণ। এই রোগে তখন ২০০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। গত বছর ডেঙ্গির সবচেয়ে বড় আক্রমণ হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গেই। ১৭৭০২ জন মানুষ গত বার এ রাজ্যে এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। গত বছর পর্যন্ত দেশের কোনও রাজ্যে ডেঙ্গিতে আক্রান্তের এটাই ছিল সর্বোচ্চ সংখ্যা।
সুতরাং ডেঙ্গি প্রতিরোধে যে বিশেষ ভাবে তৎপর হওয়া প্রয়োজন, তা বোঝার জন্য নীতিনির্ধারকদের কাছে তথ্য ও পরিসংখ্যানের অভাব ছিল না। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে তৎপরতা না থাকায় অনুকূল আবহাওয়ায় এ বছর ডেঙ্গির প্রকোপ আরও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াল। এবং শাসকরা তাতে দিশেহারা হয়ে কখনও পরিসংখ্যান নিয়ে কখনও বা ডেঙ্গি পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন।
জনস্বাস্থ্যের নীতিটি তো শুধু ডেঙ্গির জন্য আলাদা করে ভাববার কথা নয়, এটা সামগ্রিকতা দিয়েই দেখা দরকার। আর তা যদি দেখা হত, তবে ডেঙ্গির এই প্রাদুর্ভাব হয়তো আমাদের দেখতেই হত না। জঞ্জাল সাফাই, সুষ্ঠু নিকাশি ব্যবস্থা, এগুলি তো শুধু ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়, উদরাময়ের মতো আরও অনেক রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্যই দরকার। মশার বংশবৃদ্ধি আটকাতে পারলে তো শুধু ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রিত হয় না, ম্যালেরিয়াও নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু জনস্বাস্থ্য পরিষেবার দুর্বলতার জন্যই এখনও আমাদের দেশে ম্যালেরিয়া একটি বিপদ হিসাবে রয়ে গিয়েছে। ‘ন্যাশনাল ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’-এর অধীনে (বর্তমানে ‘ন্যাশনাল ভেক্টর বর্ন ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’) সেই ১৯৫৩ সাল থেকে ম্যালেরিয়া-বিরোধী কর্মসূচি নেওয়া শুরু হলেও আজও আমাদের দেশে প্রতি বছর ১০ লক্ষের উপর মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন। ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রক প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল হেলথ প্রোফাইল ২০১৭’ অনুযায়ী, গত বছর পশ্চিমবঙ্গে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৫২৩৬ জন এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ৫৯ জন। এই শতকের প্রথম দশকে বেশির ভাগ বছরে পশ্চিমবঙ্গে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা এক থেকে দু’লক্ষের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। কিন্তু তুলনায় সমাজের প্রান্তিক বর্গের মানুষ ম্যালেরিয়ার শিকার বেশি হওয়ায় ডেঙ্গির মতো তা নিয়ে অত হইচই নেই।
আসলে জনস্বাস্থ্যের মূল নীতি যেহেতু রোগের উৎসমূলে আঘাত করা, তাই তাতে মানব সমাজের উপকার থাকলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে যাদের ব্যবসা চলে তাদের কোনও উপকার নেই। পুষ্টিকর খাদ্য, নিরাপদ পানীয় জল, যথাযথ স্যানিটেশন, দূষণমুক্ত পরিবেশ ইত্যাদি রোগের মাত্রা কমিয়ে আনে বলে স্বাস্থ্য ব্যবসার সঙ্গে যারা যুক্ত তারা কখনওই জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ওকালতি করবে না। শোনা যায়, ভারতে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের উপর ওষুধ কোম্পানিগুলির নাকি ভীষণ প্রভাব। সুতরাং জনস্বাস্থ্যের নীতিকে শক্তিশালী করতে হলে গণ-সক্রিয়তা বাড়াতে হবে। রোগ নিরাময়ের নীতির পরিবর্তে রোগ প্রতিরোধের নীতিতে যদি আমরা এখনও জোর না দিতে পারি, তবে বিপদের দিন বেশি দূরে নেই।
ডেঙ্গির কথা যদি আলাদা করে বলতে হয় তবে বলি যে ডেঙ্গি এখন শহর ছাড়িয়ে গ্রামে পাখা মেলতে শুরু করেছে, যেখানে বহু মানুষই চিকিৎসার জন্য প্রথমে প্রশিক্ষণহীন ‘হাতুড়ে’ চিকিৎসকদের কাছেই যান। আর তাঁদের কাছে ডেঙ্গির চিকিৎসা হলে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা হয়তো প্রকাশ পাবে না, কিন্তু তাতে মানুষের মৃত্যু মিছিল বাড়বে বইকি। তখন ‘এডিস ইজিপ্টাই’ মশার বংশবৃদ্ধির প্রতিকূল মরশুম শীতের অপেক্ষায় বসে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না, কারণ গ্রামাঞ্চলে সরকারি চিকিৎসার পরিকাঠামো তো খুবই উত্তম!
(শেষ)
তথ্যসূত্র: ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রক কর্তৃক প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল হেলথ প্রোফাইল’এর বিভিন্ন সংখ্যা; অনিতা চক্রবর্তী, রোহিত অরোরা ও ক্রিস্টিন লুক্সেমবারগার-এর প্রবন্ধ ‘ফিফটি ইয়ার্স অব ডেঙ্গি ইন ইন্ডিয়া’, ‘ট্রানজাকশন অব দ্য রয়াল সোসাইটি অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন’ (২০১২)।
প্রতীচী ইনস্টিটিউট-এ কর্মরত