এভারেস্টের ব্যালকনিতে ‘ট্র্যাফিক জ্যাম’।—ছবি এএফপি।
আবহাওয়া অনুকূল এবং পর্বতারোহণের আদর্শ থাকিলেও গত ২২ মে শৃঙ্গজয় না করিয়া এভারেস্টের ব্যালকনি হইতে ফিরিয়া আসেন বাঙালি অভিযাত্রী পিয়ালী বসাক। শৃঙ্গের মাত্র ৫০০ মিটার দূর হইতে ফিরিয়া আসিবার কারণ ‘ট্র্যাফিক জ্যাম’! ব্যালকনিতে পৌঁছাইয়াই পিয়ালীরা জানিতে পারেন, সম্মুখে আড়াই শতর অধিক অভিযাত্রী অপেক্ষমাণ। অতএব প্রত্যাবর্তন। একটি পরিসংখ্যান বলিতেছে, এই মরসুমে ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে ইতিমধ্যেই প্রাণ হারাইয়াছেন এগারো জন পর্বতারোহী। অভিজ্ঞরা বলিতেছেন, পর্বতারোহণে ভিড় বাড়িলে শৃঙ্গে পৌঁছাইবার জন্য অধিক সময় অপেক্ষা করিতে হয়, ফলত প্রতিকূল আবহাওয়ার সহিত অধিক সময় জুঝিতে হয়, ইহার ফলে শ্রান্তি গ্রাস করে। ২৮ হাজার ফুট উচ্চতায় স্বল্প অক্সিজেন ও বিপুল বরফের রাজ্যে সময়ের গোলযোগ প্রাণঘাতী, দীর্ঘ প্রতীক্ষা ভয়ঙ্কর। বিগত কয়েক বছরে বহু অভিযাত্রীর মৃত্যুর পর বিষয়টি লইয়া চর্চা হইলেও সুরাহা হয় নাই। তবে ইহা স্পষ্ট হইয়াছে যে সঙ্কটটি প্রাথমিক ভাবে ব্যবসাকেন্দ্রিক।
ইতিহাস বলিতেছে, ১৯৯২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক হল ও নিউজ়িল্যান্ডের স্কট ফিশার শেরপাদের মাসিক বেতনের বন্দোবস্ত করেন, এবং তাঁহাদের সহায়তায় এভারেস্টের যাত্রাপথ নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়া দেন। নির্মিত হয় সুসজ্জিত শিবির, দড়ি লাগাইয়া আরোহণের পথ সহজতর করা হয়, অক্সিজেন সিলিন্ডার বহিয়া দিবার ব্যবস্থাও হয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলাইয়া পাহাড়ে চড়িবার উপকরণও উন্নত হয়, সরঞ্জাম ও পদ্ধতিও আধুনিক হয়। এই পন্থাতেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আরোহণ অভিযাত্রীদের চ্যালেঞ্জ হইতে যেন পর্যটকের মনোবাঞ্ছায় পর্যবসিত হয়। নির্দিষ্ট সময় সংস্থার নিকট টাকা পৌঁছাইতে পারিলেই শেরপা, শৃঙ্গের অনুমতি, তাঁবু, খাদ্য, অক্সিজেন, জ্বালানি, বরফে হাঁটিবার জুতা, এমনকি জয়ীর সংবর্ধনাও পাকা। সংস্থার তহবিলের ন্যায় নিয়ামক দেশের কোষাগারেও বিপুল অর্থাগম হইবার ফলে সরকারি স্তরও নীরব থাকে। উনিশশো পঞ্চাশের দশকে যাহা ছিল মাত্র ছয় অভিযাত্রীর অর্জন, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তাহাই হইল প্রায় চার হাজার পর্যটকের শখপূরণ।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিযাত্রীরা জর্জ ম্যালরির একটি উক্তির কথা স্মরণ করেন— পর্বতারোহণে কিছু লাভ নাই, কিছু পাইবার নাই। খ্যাতির হিসাব কষিবেন না তাঁহারা। টাকা জোগাড় হইতে অধিক গুরুত্ব পাইবে অভিযানের নেশা ও পাহাড়ের প্রতি ভালবাসা। কিন্তু রেকর্ড গড়ার অত্যুৎসাহে এই মহৎ ক্রীড়ার নিয়ম-নীতিও বিসর্জন দেওয়া হইয়াছে। বস্তুত, বর্তমানে এভারেস্ট অভিযানের ভাবনার প্রক্রিয়াটিই বদলাইয়া গিয়াছে। বদলাইয়াছে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক। কারণ, কাহারও যদি হাতে টাকা এবং শৃঙ্গজয়ের মোহ থাকে, তবেই সে এভারেস্টে চড়িতে পারে। সেই হুজুগেই প্রকৃতির নিয়মের ক্ষতি করিতেও দ্বিধান্বিত হয় না মনুষ্যজাতি। এক দিকে, নেপাল সরকার এভারেস্টে চড়িবার অনুমতিপত্র সীমিত না করিয়া পর্যটকদের ‘আনন্দ ও খ্যাতির জন্য’ আরও উৎসাহিত করিতেছে, অপর দিকে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প অবধি অ্যাসফল্ট হাইওয়ে নির্মাণ করিয়াছে চিন। ধরিত্রীর অপূরণীয় ক্ষতি হইতেছে, ইহা প্রমাণিত, তবু শ্রেষ্ঠত্বের নেশা ঠেকাইবে কে?