যোগাযোগ: ক্ষিতিমোহন সেন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শান্তিনিকেতন
এক ভাষা আর এক দেশের কথা বলে দেশকে হিন্দি-হিন্দুত্বের শিকড়ে আর ঐতিহ্যে ফেরানোর কথা বলছেন যাঁরা, তাঁরা আসলে জানেন না, এই এক ভাষা আর এক দেশের আদলটা আসলে বিলিতি। এই পোড়া দেশে আমরা কিছুই মনে রাখি না। পূর্বজরা হাত পুড়িয়ে যা শিখেছিলেন, আমরা তা ভুলে যাই, আবার ঘরে আগুন লাগাতে উদ্যত হই। বহু ভাষার বহু সংস্কৃতির বহু ধর্মের এই দেশে বিলিতি মডেল চাপিয়ে দিলে যে চলবে না, এই সত্যটি উনিশ-বিশ শতকে ভারতীয় চিন্তকেরা ক্রমশই বুঝতে পারছিলেন। মাঝে মাঝে বিলিতি মডেলের ফাঁদেও পড়ছিলেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের কথাই ভাবুন না কেন। ভারতী পত্রিকাতে শ্রাবণ ১৩০৫-এ প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ‘ভাষাবিচ্ছেদ’। সে লেখা পড়লে একেলে ‘এক ভাষা এক রাষ্ট্র’ পন্থায় বিশ্বাসীরা লাফিয়ে উঠবেন। এই তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বৃটিশ দ্বীপে স্কটল্যাণ্ড, অয়র্ল্যাণ্ড ও ওয়েল্সের স্থানীয় ভাষা ইংরেজি সাধুভাষা হইতে একেবারেই স্বতন্ত্র।... কিন্তু ইংরেজের বল জয়ী হওয়ায় প্রবল ইংরেজিভাষাই বৃটিশ দ্বীপের সাধুভাষারূপে গণ্য হইয়াছে। এই ভাষার ঐক্যে বৃটিশজাতি যে উন্নতি ও বললাভ করিয়াছে, ভাষা পৃথক থাকিলে তাহা কদাচ সম্ভবপর হইত না।” রবীন্দ্রনাথ সেই মডেল এ দেশেও গ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন। ওড়িয়া আর অসমিয়া, এই দুই ভাষার স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্য খারিজ করে সেখানে বাংলা ভাষাকে চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। বিলিতি উদাহরণের ঠুলি পরে তাঁর মনে হয়েছিল ‘আসামি এবং উড়িয়া... বাংলার সগোত্র ভাষা’, তাই এই দু’টি ভাষাকে বাতিল করে বাংলাকেই এক ভাষা হিসেবে চালু করা হোক। স্বভাবতই প্রতিবাদের মুখে পড়েন রবীন্দ্রনাথ। লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া প্রতি-যুক্তি দেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। বিলিতি একীকরণের কায়দায় ভারতীয় ভাষাগুলির ওপরে কোনও একটি ভাষার আধিপত্য কায়েম করা যে অনুচিত, এ কথা বুঝতে খোলামনের মানুষ রবীন্দ্রনাথের বিশেষ সময় লাগেনি। ভারতের মতো বহু ভাষার দেশ এ ভুবনে কোথায়? ওপর থেকে এক ভাষার ছাঁচ চাপানো অর্থহীন। বিলিতি মডেল নৈব নৈব চ। সাহেবি ভূতের টিকি যখন দেখা যায়নি, তখন ভক্তিধর্মের প্লাবনে যে এক রকম সংযোগ তৈরি হয়েছিল, সেই সংযোগের ক্ষেত্রে কোনও এক ভাষার আধিপত্য কায়েম করতে হয়নি। ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে পারস্পরিক বোধগম্যতা নিজের মতো করে তৈরি হয়েছিল। সংশোধিত রবীন্দ্রনাথের কাছে বিলিতি মডেলের চেয়ে সেই প্রাক্-আধুনিক স্বদেশি মডেলের গুরুত্ব অনেক বেশি।
১৯২৩। কাশীতে উত্তর-ভারতীয় বঙ্গসাহিত্য সম্মিলনে সভাপতির অভিভাষণ দিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ প্রবন্ধে যা লিখেছিলেন, তা শুধরে নিলেন। বললেন, “সাম্রাজ্যবন্ধনের দোহাই দিয়ে যে-ঐক্যসাধনের চেষ্টা তা বিষম বিড়ম্বনা।... নেশনরা আপন অধীন গণবর্গকে এক জোয়ালে জুড়ে দিয়ে বিষম কশাঘাত করে...।” এই যে একজোয়ালে গরুর মতো জনগণকে জুড়ে দিয়ে চাবুক মেরে চালানোর চেষ্টা, সেই চেষ্টাতেই ‘তারা ভাষা-বৈচিত্র্যের উপর স্টীম-রোলার চালিয়ে দিয়ে আপন রাজপথের পথ সমভূম করতে চায়।’ ১৯২৩-এর রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, এ ঘোরতর অন্যায়। লিখলেন, ইংরেজির বদলে ‘অন্য একটি ভাষাকেও ভারতব্যাপী মিলনের বাহন করবার প্রস্তাব হয়েছে। কিন্তু, এতে করে যথার্থ সমন্বয় হতে পারে না; হয়তো একাকারত্ব হতে পারে, কিন্তু একত্ব হতে পারে না।’ এই যে ‘একাকার’ করে দিতে চাওয়া, এর পিছনে কাজ করছে জুলুম, আর ‘একত্ব’ ভেতর থেকে বন্ধুত্বের মধ্যে জেগে ওঠে, তা জুলুম নয়।
এই একত্ব কেমন করে আসবে? রবীন্দ্রনাথের অভিমত, ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে পারস্পরিক বিনিময়ের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। ৩ মার্চ ১৯২৩-এর সেই বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, বঙ্গবাসীর সঙ্গে উত্তর ভারতের যোগাযোগ তৈরি হোক। হিন্দি আর বাংলা দুইয়ের মধ্যে গড়ে উঠুক সহজ বন্ধুত্ব। রবীন্দ্রনাথ হিন্দি জানতেন না। তবে ক্ষিতিমোহন সেনের কাছ থেকে ‘প্রাচীন হিন্দি সাহিত্যের আশ্চর্য রত্নসমূহের কিছু কিছু পরিচয়’ তিনি পেয়েছিলেন। ক্ষিতিমোহন শান্তিনিকেতনে আসেন ১৯০৮-এ। সংস্কৃতজ্ঞ ক্ষিতিমোহন সাধু-সন্তদের আখড়ায় ঘুরতেন, মধ্যযুগের ভারতীয় ভক্তিভাবুকদের জীবন-বাণী সংগ্রহ করতেন। তাঁর কাছ থেকেই রবীন্দ্রনাথ হিন্দি ভাষাবাহিত এই উদার সমন্বয়ী ভারতের সন্ধান পেয়েছিলেন। হিন্দি ভাষার উপর শ্রদ্ধা ছিল বলেই তাঁর শিক্ষালয়ে গড়ে উঠেছিল ‘হিন্দী ভবন’, সে ১৯৩৮ সালের কথা। রাষ্ট্রীয় রথের ঘর্ঘর শব্দ তুলে হিন্দি শান্তিনিকেতনে আসেনি, এসেছিল সাংস্কৃতিক সহজ বিনিময়ের পথ ধরে।
রবীন্দ্রনাথ নাহয় হিন্দি জানতেন না, কিন্তু সব বাঙালিই রবীন্দ্রনাথের মতো নন। ভারতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দির গুরুত্ব স্বীকার করতেন তাঁরা, চর্চাও করতেন। বিদ্যাসাগরের হিন্দিজ্ঞান ছিল প্রখর। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য বিপিনবিহারী গুপ্তকে জানিয়েছেন একটি মজার ঘটনার কথা। এক জন হিন্দুস্থানি পণ্ডিত এসেছেন বিদ্যাসাগরের কাছে, সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছেন তিনি। বিদ্যাসাগর জবাব দিচ্ছেন হিন্দিতে। পাশে তখন কৃষ্ণকমল। বিদ্যাসাগর কৌতুকের সুরে চুপিচুপি তাঁকে বলছেন, “এ দিকে কথায় কথায় কোষ্ঠশুদ্ধি হোচ্চে, তবুও হিন্দি বলা হবে না!” খারাপ সংস্কৃত বলার চেয়ে যে নব্য ভারতীয় ভাষাগুলিতে নিজেদের মধ্যে কথা বলা ভাল, এ কাণ্ডজ্ঞান বিদ্যাসাগরের ছিল। সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের তিনি খুব ভাল করে মাতৃভাষা চর্চা করতে বলতেন। ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে পারস্পরিক বিনিময়ের সম্পর্কের কথা মাথায় রেখেই তো তিনি হিন্দি থেকে বাংলায় বেতাল পঞ্চবিংশতি অনুবাদ করেন। তেমনই, বিবেকানন্দের চিঠিতে রয়েছে হিন্দিতে বক্তৃতা দেওয়ার খবর। রামকৃষ্ণানন্দকে আলমোড়া থেকে চিঠিতে লিখছেন, “কিন্তু তার আগের দিন হিন্দিতে এক বক্তৃতা করি, তাতে আমি বড়ই খুশী – হিন্দিতে যে oratory করতে পারবো তা তো আগে জানতাম না।” বিদ্যাসাগর বা বিবেকানন্দ কেউই হিন্দিকে অবজ্ঞা করছেন না, ভারতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করছেন, কাজে লাগাচ্ছেন। সাংস্কৃতিক সংযোগই সেখানে মুখ্য, রাষ্ট্রীয় বাহুবল সেখানে নেই। বিবেকানন্দের পিতা আইনজীবী; ইংরেজি, বাংলা ছাড়াও আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দিতে তাঁর দখল ছিল। সেই বহুভাষিকতার বোধ বিবেকানন্দেও বর্তে ছিল। ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার তখন পটনা কলেজে অধ্যাপনা করেন। ইতিহাস পড়াতে গিয়ে বুঝলেন, ইংরেজি বলে লাভ নেই, হিন্দিতে পড়ালেই পড়ুয়াদের উপকার হবে, হিন্দিতেই পড়াতেন তিনি। তাঁর এই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন মডার্ন রিভিউ-তে। উদাহরণ অনেক। বুঝতে অসুবিধে হয় না, ভারতের মতো বহুভাষী দেশে প্রয়োজনমতো বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সংযোগের ক্ষেত্র তৈরি করাই যে উচিত, তা অনেকেই বুঝতে পারছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে শুধরে নিয়ে ঠিক পথেই এগিয়েছিলেন।
ভারতীয় সংস্কৃতির বহুত্ব, ভারতীয় ভাষাগুলির পারস্পরিক বিনিময়ের ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে আবার যখন রবীন্দ্রনাথের বাতিল করা বিদেশি মডেলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা ওঠে, তখন ভয় হয়। এত বড় দেশ, নানা তার ভাষা। এক ভাষার আগলে নিজেকে আটকে রাখার উপায় নেই। অন্যের বুলি তো জানতেই হবে, শিখতে হবে একাধিক ভাষা। হিন্দিবিরোধী বাঙালিদের মনে রাখতে হবে, এ ভাষার নানা রূপ নানা ভেদ, হিন্দি কেবল উচ্চবর্ণ হিন্দুত্ববাদীদের ভাষা নয়, তা অন্য রূপে নানা কৌমেরও ভাষা। এমনকি, যে ইংরেজি এক কালে বিলিতি ভাষা হিসেবে চিহ্নিত হত, তা-ও তো এখন ভারতীয় ভাষাই— সে ভাষার ভারতীয় রূপ স্বীকৃত, বহু ব্যবহৃত। পাশাপাশি প্রযুক্তির কুশলতায় দ্রুত এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদের কাজও সহজ হবে। ব্যবসায়ীরাও জানেন, বহুভাষী ভারতের মানুষ তাঁদের নিজের ভাষাতেই কেনাকাটা করতে ভালবাসেন। তা হলে কেন এক ভাষার কাঠামোয় ঠারেঠোরে এই বহুত্ববাদী দেশকে ঢোকানোর চেষ্টা? সে কাজ করতে গিয়ে তো হাত পুড়েছিল, আবার কি ঘর পোড়ানোর উপক্রম না করলেই নয়?
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী