সব খেলার সেরা

প্রতিদ্বন্দ্বী দলের এমন উদ‌্‌যাপন, আবেগঘন বার্তা অভিনব। কিন্তু অপ্রত্যাশিত নহে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৯ ০০:৪২
Share:

ছবি: সংগৃহীত।

শতবর্ষে পা রাখিল ইস্টবেঙ্গল ফুটবল ক্লাব। এমন একটি ক্লাব, খেলার গণ্ডি অতিক্রম করিয়া এক বিপুল সংখ্যক মানুষের নিকট যাহা ছাড়িয়া আসা ভিটামাটির প্রতীক হইয়া উঠিয়াছিল। জীবনযুদ্ধে পরাজিত, ধ্বস্ত মানুষগুলি এই দলটির হাত ধরিয়াই জয়ী হইবার স্বপ্ন দেখিয়াছিল। সেই ইতিহাস ভুলিবার নহে। তাই শতবর্ষে পা দিবার লগ্নে অগণিত সাধারণ মানুষের শুভেচ্ছাও তাহার সঙ্গী হইয়াছে। কোথাও রোপণ করা হইয়াছে ১০০ গাছের চারা, কোথাও রাস্তার দু’ধার ঢাকা পড়িয়াছে ক্লাবপতাকা ও ইলিশ মাছের ছবিতে। আবার, কোথাও মোহনবাগানের কট্টর সমর্থকরা ইস্টবেঙ্গলের প্রতিষ্ঠা দিবসটি পালন করিয়াছেন সাড়ম্বরে, রীতিমতো ক্লাবপতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জনৈক মোহনবাগান সমর্থক লিখিয়াছেন, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তাঁহার চিরশত্রু। কিন্তু এই চিরশত্রুতা যেন বৎসরের পর বৎসর টিকিয়া থাকে। লাল-হলুদ ক্লাব যেন দীর্ঘজীবী হয়।

Advertisement

প্রতিদ্বন্দ্বী দলের এমন উদ‌্‌যাপন, আবেগঘন বার্তা অভিনব। কিন্তু অপ্রত্যাশিত নহে। বাঙালির ফুটবলের ধারাটিকে লক্ষ করিলে বুঝা যায়, তাহার চরিত্র এমনই। সেখানে শত্রুতা দীর্ঘস্থায়ী হইতে পারে, রক্তক্ষয়ী নহে। শত্রুতার ভিতরেও এত কাল অনেকটা ‘খেলা’ মিশিয়া থাকিয়াছে। সেখানে মোহনবাগান হারিলে সমর্থকের বাড়িতে ইস্টবেঙ্গল প্রতিবেশী ইলিশ পাঠাইয়াছে, ইস্টবেঙ্গল হারিলে উপহার মিলিয়াছে চিংড়ি। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে গ্যালারি দুই ভাগ হইয়াছে। এক পক্ষের সমর্থক দৈবাৎ অন্য পক্ষের গ্যালারিতে প্রবেশ করিলে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ছুটিয়া আসিয়াছে। কিন্তু সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, সেই রেষারেষিতে রক্তপিপাসা ছিল না। সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধিয়াছে ঠিকই, কিন্তু কেহ কাহারও নিপাত কামনা করেন নাই। জাতিগত বিদ্বেষ সেখানে নিয়ন্ত্রক হইয়া দাঁড়ায় নাই। বরং এমন নজির আছে, যেখানে বিপক্ষের ফুটবলারকে গালি দিবার শাস্তিস্বরূপ সদস্যপদ বাতিল হইয়াছে, বিপক্ষের আহত সমর্থককে ক্লাবের পক্ষ হইতে হাসপাতালে দেখিতে যাওয়া হইয়াছে। সর্বোপরি, এই সবুজ-মেরুন বনাম লাল-হলুদ দ্বন্দ্বের মধ্যে আভাস মিলিয়াছে এক নিখাদ রঙ্গের। যে রঙ্গ-রসিকতা বাঙালির এক সময়ের বৈশিষ্ট্য।

এই অম্ল-মধুর শত্রুতাটির এই সময় বড় প্রয়োজন। যেখানে ভিন্ন মত থাকিবে, কিন্তু তাহা পারস্পরিক বিদ্বেষের জন্ম দিবে না। পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে এক সহনীয় ভাব বজায় থাকিবে। পূর্ববঙ্গ হইতে স্রোতের মতো ভাসিয়া আসা উদ্বাস্তুদের প্রতি এ-পার বাংলার মানুষরা অতিশয় সদয় ছিল, এমনটা নহে। পশ্চিমবঙ্গবাসীকেও তখন লড়িতে হইয়াছে চেনা শহরটির হঠাৎ রূপবদলের সঙ্গে। কিন্তু সেই বিরূপ মনোভাব ধীরে ধীরে স্তিমিত হইয়াছে। সেই দ্বন্দ্বও প্রতীকী হইয়া শুধুমাত্র ঠাঁই পাইয়াছে ফুটবলের মধ্যে। অন্য ক্ষেত্রে তাহা হয় নাই। বরং ধর্ম, জাতপাতের ক্ষেত্রে যে বিরূপতা অলক্ষ্যে জ্বলিতেছিল, ভারতের সাম্প্রতিক রাজনীতি তাহাকে একেবারে বেআব্রু করিয়া দিয়াছে। নাগরিকের মধ্যে এতটাই বিষ ভরিয়া দিয়াছে যে, জন্ম লইয়াছে এক সীমাহীন এবং দীর্ঘস্থায়ী পারস্পরিক বিদ্বেষ। সেখানে সামান্য মতানৈক্যও অসহ্য, যেন তেন প্রকারে তাহার কণ্ঠরোধ করাতেই গৌরব। নিষ্কলুষ রসিকতার সেখানে স্থান নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement