দুবরাজপুরে শিক্ষক দিবস পালন। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত
প্রতি বছর ৫ সেপ্টেম্বর দিনটি মহা সমারোহে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়। এই দিনটি সমস্ত ছাত্রছাত্রী- শিক্ষকদের কাছে একটি বিশেষ দিন। এই দিনটিতে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষক-শিক্ষিকার আরও কাছে আসে, সম্মান ও স্নেহের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। সরকার পোষিত স্কুলগুলির ছেলেমেয়েরা যখন তাদের প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকার জন্য উপহার নিয়ে হাজির হয়, শুনতে হয় মৃদু বকুনি, ‘‘এ সব কেন এনেছিস?’’ তারা হাসে। কচিকাঁচা মুখগুলো অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব পেয়ে ঝলমল করে ওঠে। কিন্তু বেশিরভাগ সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে এই দিনটি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পালিত হয়।
বেশ কিছু শিক্ষক শিক্ষক দিবসে সংবর্ধিত হন। কিন্তু আরও অনেক শিক্ষক আড়ালে থেকে যান যাঁরা নিজেদের অজান্তেই আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যান। কথায় আছে, ‘‘যতদিন বাঁচি, ততদিন শিখি।’’ আর কে না শেখায় আমাদের! স্বজনহারা যে মানুষটি সারারাত জেগে কাটিয়েছেন, ভোরের প্রথম আলো তাকে শিখিয়ে দিয়ে যায়, সব রাতের পরেই দিন আসে, দুখের পরে সুখ। রোদ ঝকঝকে দিনে মুহূর্তের মধ্যে যখন আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়, ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়, সে আমাদের মনে করিয়ে দেয় জীবনে নিশ্চয়তার কোনও স্থান নেই; সদা সর্বদা বিপদের জন্য প্রস্তুত থেকো। আবার যখন কিছুক্ষণ পরেই হাসিমুখে সূর্যদেব আসেন, আমরা আশাবাদী হই।
হতদরিদ্র ভিখিরি, অটো বা ট্যাক্সি চালকের ব্যাগভর্তি টাকা ফেরত দেওয়ার খবর আমরা কাগজের পাতায় প্রায়ই পড়ি। সেই সৎ মানুষগুলো কি বড় শিক্ষক নন? এক ধর্মের মানুষ যখন অন্য ধর্মের মানুষকে রক্ষার জন্য বিপদের ঝুঁকি নেন তখন তাঁর কাজ লক্ষ লক্ষ মানুষকে মানবতার পাঠ পড়িয়ে দেয়।
পর পর তিন বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল হেরে চতুর্থ বার পি ভি সিন্ধুর বিশ্বজয়ীর হাসি কি দেশ তথা পৃথিবীর সব ছাত্র ছাত্রীদের কিছু শেখায় না? কেবলমাত্র নিয়মের জন্য ক্রিকেট বিশ্বকাপ হাতছাড়া করেও নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ক্যাপ্টেন যখন কোনও অনুযোগ করেন না তখন সেই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীতে তাঁর থেকে আদর্শ শিক্ষক আর কেউ থাকেন না। তিনি সব মানুষকে স্পোর্টসম্যানশিপের পাঠ দেন। শেখান ভদ্রতা কাকে বলে, কাকে বলে প্রকৃত শিক্ষা ।
ছোট ছোট গ্রামের শিশুরা যখন প্লাস্টিক কুড়িয়ে বেড়ায়, প্লাস্টিকমুক্ত গ্রাম গড়ার শপথ নেয় সেই সময় কি তারা আমাদের শিক্ষক হয়ে ওঠে না? সুস্থ জীবন থেকে হঠাৎ যখন কেউ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েও হার মানেন না, প্রাণপণ লড়ে মারণরোগকে পরাস্ত করেন, তখন বিশ্বজোড়া ক্যানসার রোগীর তিনি আদর্শ শিক্ষক ।
চায়ের দোকানে কাজ করা ছেলেটি যখন চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট করে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে; প্রত্যন্ত পরিবার থেকে যখন কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, আইএস ইত্যাদি হন তখন আপ্লুত মন তাঁকে শিক্ষক হিসেবে মেনে নেয়। প্যারা-ব্যাডমিন্টনে বিশ্বজয়ী মানসী, অটিজমের শিকার ছেলেটি যে মাধ্যমিকে কৃতী তাঁরা সবাই শিক্ষক।
শত প্রলোভনেও যাঁরা অসৎ পথে পা বাড়ান না, যাঁরা নিজেদের কর্তব্য ভোলেন না, রাতবিরেতে এক বার হাঁক দিলেই যে ছেলেটি রক্ত দিতে হাজির হয়ে যান তাঁরা সবাই শিক্ষক। প্রতিবেশীর আপদে বিপদে যিনি পাশে থাকেন তিনিও শিক্ষক। এখনও যাঁরা প্রতিবাদী, যারা মানুষের অধিকার রক্ষায়, মানবতা রক্ষায় সদা সচেষ্ট, তাঁরা সবাই শিক্ষক ।
সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন এক জন প্রকৃত শিক্ষক ছিলেন। তিনি নিজের জন্মদিন পালন করতে চাননি, দেশের শিক্ষককুলকে সেই দিনে সম্মানিত হতে দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর সেই অভীপ্সা পূরণ হয়েছে। ভারতের বহু মানুষ প্রতি বছর এই দিনটির জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করেন। আমাদের রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র সরকার এই বিশেষ দিনটিতে প্রতি বছর কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকাকে সম্মানিত করেন। বহু মানুষই এই দিনটিতে নিজের ছাত্র জীবনে ফিরে যান। সশ্রদ্ধে প্রয়াত বা অবসরপ্রাপ্ত বা এখনও কর্মরত শিক্ষক শিক্ষিকাদের স্মরণ করেন। এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা এই বিশেষ দিনটিতে এক বিশেষ শিক্ষকের বাড়িতে হাজির হন। হয়তো বাকি দিনগুলোয় নানা কারণে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু বিশেষ দিনটিতে তাঁরা এসে দাঁড়ান শিক্ষকের দ্বারে। বলেন ‘চরণ ছুঁয়ে যাই।’
আমাদের প্রবাদপ্রতিম খেলোয়াড় সচিন তেন্ডুলকর প্রতি বছর দেশে থাকলেই হাজির হয়ে যেতেন তাঁর কোচ রমাকান্ত আচরেকরের বাড়িতে। এমন বহু সচিন আছেন যাঁরা কোনও না কোনও শিক্ষকের কাছে আজন্ম ঋণী। বহু শ্রদ্ধেয় প্রথাগত শিক্ষক শিক্ষিকা রয়েছেন। কেউ পড়া শেখান, কেউ ছবি আঁকা, কেউ গান, কেউ কবিতা, কেউ নাচ।
এর বাইরেও অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা কেউ বাঁচতে শেখান, কেউ হাসতে, কেউ জীবনকে ভালবাসতে। তাঁদের মধ্যে অনেক সাধারণ মানুষও আছেন যাঁরা প্রত্যক্ষ ভাবে শিক্ষাব্যবস্থার সাথে যুক্ত নন। কিন্তু তাঁদের কাজ, তাঁদের জীবন কাহিনি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়। কখনও হয়তো ওঁরা দু’-এক জন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন, কখনও বা অনেককে।
মনীষীদের জীবনী থেকে আমরা আজীবন শিখি। এ ছাড়াও এই পৃথিবীতে অনেকেই শিক্ষক। প্রকৃতি, পশু-পাখি, সাধারণ মানুষ প্রায় সকলের কাছেই কিছু না কিছু শেখার আছে। শুধু চাই শেখার মতো মন, বুদ্ধিবৃত্তি, হৃদয়বৃত্তি। শিক্ষক দিবসের সময়কালে তাই জানা, অজানা সমস্ত শিক্ষিক-শিক্ষিকাকে জানাই আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা। শেখার মতো মন যেন মানুষের থাকে, যাঁর কাছে যা শিক্ষণীয় মানুষ যেন তা চিরদিন শেখে অকুণ্ঠ চিত্তে, নির্দ্বিধায়—এইটুকুই প্রার্থনা ।
লেখক শিক্ষিকা, মতামত নিজস্ব