ভারতের রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। ব্যাঙ্কের কাজে সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ করেছেন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য, গভর্নর উর্জিত পটেলেরও যাতে সায় আছে। সে অভিযোগ যে সত্যি তার প্রমাণ, সম্প্রতি আরবিআই অ্যাক্টের সাত নম্বর ধারা উল্লেখ করে অর্থ মন্ত্রক রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে তার ঋণনীতি শিথিল করার পরামর্শ দিয়েছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের চুরাশি বছরের ইতিহাসে এই প্রথম সাত নম্বর ধারার উল্লেখ ঘটল। যে হেতু একমাত্র চরম কোনও সঙ্কটের অবস্থাতেই সাত নম্বর ধারা প্রয়োগ করা যেতে পারে, এবং যে হেতু সে রকম কোনও সঙ্কট সম্প্রতি দেখা যায়নি, তাই সরকারের এই পদক্ষেপকে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতায় অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছু বলা যাচ্ছে না।
মোটের ওপর চারটে বিষয় নিয়ে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে সরকারের বিরোধ। প্রথমত, জাতীয় ব্যাঙ্কগুলোর পাহাড়-প্রমাণ জমে ওঠা অনাদায়ী ঋণের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এগারোটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে বিশেষ নজরদারির আওতায় এনেছে। এদের কার্যকলাপ, বিশেষত নতুন ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে তাদের স্বাধীনতা, অনেকটাই খর্ব করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের বক্তব্য, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক আরোপিত এই বিধিনিষেধের ফলে ব্যবসায়ীরা ধার পাচ্ছেন না, বিনিয়োগ মার খাচ্ছে, আর্থিক বৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। তাই সরকার রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উপর তাদের ঋণ নীতি শিথিল করার জন্য চাপ দিয়েছে।
দ্বিতীয় বিরোধ সুদের হার নিয়ে। প্রত্যেক ত্রৈমাসিকে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের একটি কমিটি মূল সুদের হার ঠিক করে দেয়। সরকার চাইছে, সুদের হার কমানো হোক, যাতে আরও বিনিয়োগ, আরও বৃদ্ধি হতে পারে। অপর পক্ষে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক কমানো দূরের কথা, সম্প্রতি সুদের হার বাড়িয়েছে। তাদের বক্তব্য, সুদের হার অযৌক্তিক ভাবে কমালে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়া বেড়ে যাবে, বাজারে নগদের জোগান বাড়বে, ফলে মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের আরও আশঙ্কা, ঋণ সুলভ হলে ‘খারাপ ঋণ’-এর পরিমাণও বাড়বে। বিশেষত ঋণের বড় অংশ নির্মাণ-শিল্পে বিনিয়োগ করা হবে। আবার ব্যাঙ্ক থেকে সহজ শর্তে ধার নিয়ে লোকেও বাড়ি-ফ্ল্যাট বেশি করে কিনবেন। ফলে বাড়ি-জমি-ফ্ল্যাটের দামে ও সামগ্রিক ভাবে নির্মাণ-শিল্পে একটা বুদ্বুদ তৈরি হবে। তা থেকে সাময়িক ভাবে ধারণা প্রচলিত হতে পারে যে, দেশের অর্থনীতিতে জোয়ার এসেছে। কিন্তু নানা দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গিয়েছে, নির্মাণ-শিল্পের বুদ্বুদ শেষ পর্যন্ত ফেটে গিয়ে এক ভয়ঙ্কর সঙ্কটের সৃষ্টি করে। পূর্ব এশিয়ার সঙ্কট কিংবা আরও সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবপ্রাইম ক্রাইসিস, নানা সঙ্কটের পিছনেই নির্মাণ-শিল্পের বুদ্বুদ একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল।
তৃতীয় বিরোধ, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর লভ্যাংশ বণ্টন করা নিয়ে। সরকারের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। বাজেটের ঘাটতি বেড়েই চলেছে। তার ওপর সামনে নির্বাচন, নির্বাচনের আগে জনমোহিনী প্রকল্পগুলো কার্যকর করতে গেলে অনেক টাকার দরকার পড়বে। তাই ব্যাঙ্কের লভ্যাংশ থেকে আরও বেশি করে ডিভিডেন্ড দাবি করছে সরকার। মালিক হিসেবে সরকার সেটা চাইতেই পারে, কিন্তু রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এই দাবির বিরোধিতা করছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের মতে, শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বেশি হারে লভ্যাংশ বণ্টন না করে ব্যাঙ্করা যদি সেই লভ্যাংশ পুনর্বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে নিজেদের পুঁজি বাড়াতে পারে তা হলে তাদের ভিত শক্ত হবে, সামগ্রিক ভাবে দেশের আর্থিক ব্যবস্থাটাও দৃঢ় হবে। অপর পক্ষে, নিজের আয়ের বর্ধিত অংশও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সরকারকে দিতে রাজি নয়। লভ্যাংশ বণ্টনের সিদ্ধান্ত নেয় সংশ্লিষ্ট বোর্ড। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বোর্ডে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর জন্য সরকার নচিকেত মোরের মতো ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞকে ছাঁটাই করে নিজেদের পছন্দের লোক, স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের স্বঘোষিত অর্থনীতিবিদ, নোট বাতিলের অন্যতম প্রবক্তা, গুরুমূর্তিকে বসিয়েছে।
চতুর্থ বিরোধ, নন ব্যাঙ্ক ফিনানশিয়াল কোম্পানি, সংক্ষেপে এনবিএফসি-দের ঋণমুক্তি নিয়ে। সম্প্রতি আইএলএফএস-সহ বেশ কয়েকটি এনবিএফসি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ দিতে পারছে না। সরকারের ইচ্ছে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এদের সাহায্যে এগিয়ে আসুক। পক্ষান্তরে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের আর এক ডেপুটি গভর্নর এন এস বিশ্বনাথন সম্প্রতি বলেছেন, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাথমিক উদ্দেশ্য আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষা করা, ঋণখেলাপি ঋণগ্রহীতাদের উদ্ধার করা নয়। বুঝতে কষ্ট হয় না, ঋণখেলাপি এনবিএফসি-রাই এই বিবৃতির প্রধান লক্ষ্য। প্রসঙ্গত, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক আইএলএফএস-কে উদ্ধার করতে অস্বীকার করায় সরকার সেই কাজটা এলআইসি-কে দিয়ে করিয়েছে, বা বলা ভাল, তাদের করতে বাধ্য করেছে।
সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের বিরোধ নতুন কিছু নয়। নানা দেশে নানা সময়ে এই রকম বিরোধ দেখা গিয়েছে। অতীতে আমাদের দেশেও দেখা গিয়েছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে সরকারের মতানৈক্য, কিন্তু আগে কখনও তা এই আকারে দেখা যায়নি। বিরোধের ওপরের চেহারাটা যা-ই হোক, আসল কারণটা হল কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক এবং সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটা নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ কোথাও চার বছর, কোথাও পাঁচ। এই সীমিত সময়ের মধ্যেই তাকে কিছু একটা করে দেখাতে হয়, নইলে তার পক্ষে আবার জিতে ফিরে আসাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা স্বল্পমেয়াদি। পক্ষান্তরে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক মেয়াদ আজীবন। ফলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটাও মূলত দীর্ঘমেয়াদি। এখন, দেশের স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের একটা সংঘাত থাকাই স্বাভাবিক। সুদের হার কমানো নিয়ে সরকারের সঙ্গে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বিরোধটা এই সংঘাতের একটা উদাহরণ। এ রকম উদাহরণ আরও আছে।
উইলিয়াম নর্ডহাউস এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭৫ সালের একটি গবেষণাপত্রে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, নির্বাচনের ঠিক আগে ক্ষমতাসীন দলগুলো ভোটারদের মন পেতে কল্যাণমূলক খাতে খরচ বাড়িয়ে দেয়, ফলে সাময়িক ভাবে দেশে অর্থনৈতিক লেনদেন বাড়ে, নতুন কর্মসংস্থান হয়। নির্বাচন হয়ে গেলে যে দল ক্ষমতায় আসে তারা দেখে, পূর্ববর্তী সরকারের অতিরিক্ত খরচের ফলে মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়ছে, অর্থনীতি বেসামাল হয়ে পড়ছে। তখন সরকারি খরচ আবার সঙ্কুচিত হয়, উৎপাদন, কর্মসংস্থান আবার কমে আসে। অর্থনীতির এই ওঠাপড়া, যার পোশাকি নাম বিজ়নেস সাইক্ল, নর্ডহাউসের মতে মূলত রাজনৈতিক কারণেই ঘটে। এই তত্ত্বকে অবশ্য পরবর্তী কালে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন। সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছেন, মানুষ কি এতই বোকা আর স্মৃতিশক্তিহীন যে নির্বাচন-পূর্ববর্তী বর্ধিত সরকারি খরচটা সাময়িক, এটা বুঝতে পারবে না? ভোটাররা দেখবে, বার বার নির্বাচনের ঠিক আগে সরকারি খয়রাতি বেড়ে যাচ্ছে আর নির্বাচনের পরেই কমে যাচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি লাভ কিছু হচ্ছে না, শুধু সাময়িক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। ফলে শুধু নির্বাচন-পূর্ববর্তী সরকারি খয়রাতি দেখে ভোটাররা ক্ষমতাসীন সরকারকে ভোট দেবে না। যদি তারা তা না দেয় তা হলে ক্ষমতাসীন দলগুলোও নির্বাচনের আগে বাড়তি খরচের চেষ্টা করবে না। অর্থাৎ নর্ডহাউসের সমালোচকরা বলবেন, যদি ধরে নেওয়া হয় ভোটাররা যুক্তিবাদী, স্মৃতিধর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, তা হলে নির্বাচনের আগে সাময়িক ভাবে সরকারি খরচ বেড়ে যাওয়ার কোনও কারণ নেই।
দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশের সাধারণ ভোটাররা অতটা তলিয়ে ভাবেন না, তাঁদের স্মৃতিশক্তিও তেমন প্রখর নয়। কাজেই ভোটের আগে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো খরচ বাড়িয়ে ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করে এবং এর ফলে অর্থনীতিতে একটা ওঠাপড়া, একটা অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। মূল্যস্ফীতির হারও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। সেই জন্যই এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের একটা জরুরি ভূমিকা আছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের মূল কাজ সুদের হারের মাধ্যমে নগদের জোগান বেঁধে দিয়ে মূল্যবৃদ্ধির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং ব্যাঙ্কগুলোর ঋণ নীতির ওপর প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ আরোপ করে ভারতীয় আর্থিক বাজারকে স্থিতিশীল রাখা। সরকার যদি সেই কাজে বাধা সৃষ্টি করে তা হলে দীর্ঘমেয়াদের বিচারে সাধারণ মানুষকেই দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক, আলবের্তো অ্যালেসিনা এবং লরেন্স সামার্স, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের স্বাধীনতার সঙ্গে দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনীতির একটা আশ্চর্য সম্পর্ক লক্ষ করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের স্বাধীনতা বাড়লে মূল্যবৃদ্ধির হার কম হয়, কিন্তু সেই স্বাধীনতা বাড়া-কমার সঙ্গে দেশের দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন বা কর্মসংস্থানের কোনও সম্পর্কই নেই। অর্থাৎ যে সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো তুলনায় স্বাধীন, সে সব দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার কম, কিন্তু এই স্বাধীনতার কোনও কুপ্রভাব দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন বা কর্মসংস্থানের উপর পড়েনি। তা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে স্বাধীনতা দিতে অসুবিধে কোথায়?
অসুবিধে একটাই। যাঁরা এখন ক্ষমতায় আছেন তাঁরা দেশের মানুষের দীর্ঘমেয়াদি মঙ্গল নিয়ে ভাবছেন না। তাঁদের চোখ একমাত্র পরবর্তী নির্বাচনের দিকে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট,
কলকাতায় অর্থনীতির শিক্ষক