বিষবৃক্ষে ফল ধরিল। ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কমিয়াছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের স্থান একশো আশিটি দেশের মধ্যে একশো-ছত্রিশতম। গত বৎসরের তুলনায় আরও তিন ঘর পিছাইয়া, পাকিস্তানের তিন ঘর আগে ভারতের অবস্থান হইয়াছে। যাঁহারা এই তালিকা প্রস্তুত করেন, সংবাদকর্মীদের সেই প্রতিষ্ঠান তাহার রিপোর্টে লিখিয়াছে, ইহা হিন্দুত্ববাদীদের উগ্র জাতীয়তার অবদান। তথাকথিত ‘দেশপ্রেম’ লইয়া বিতর্ক তুলিলেই সাংবাদিকদের উপর খড়্গহস্ত হইতেছে হিন্দুত্ববাদীরা। সরকারের সমালোচনা করিলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনিবার ভয় বাড়িতেছে। যাঁহারা ইহাতেও কাতর হন নাই, সেই সাংবাদিকদের মিথ্যা মামলায় হয়রান করিবার দৃষ্টান্ত যথেষ্ট রহিয়াছে। দিল্লির সাংবাদিক নেহা দীক্ষিত তদন্তে পাইয়াছিলেন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ সব বিধি ভাঙিয়া অসমের আদিবাসী শিশুকন্যাদের অন্য রাজ্যে আনিতেছে। এই ‘ঘর ওয়াপসি’ কার্যসূচির রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হইলে সাংবাদিক, পত্রিকা সম্পাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষ ছড়াইবার অভিযোগে মামলা করিয়াছিল শাসক দল বিজেপি। অবৈধ বালি কারবারের বিরুদ্ধে লিখিবার জন্য মানহানির মামলা রুজু হইয়াছে তামিল সাংবাদিক সন্ধ্যা রবিশঙ্করের বিরুদ্ধে। সাংবাদিকদের চরিত্রহনন, তাঁহাদের ধর্ষণ, নির্যাতন ও খুনের হুমকির বন্যা বহিতেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
নেহা কিংবা সন্ধ্যাকে গ্রেফতার হইতে হয় নাই, কিন্তু সে ঝুঁকি এড়াইতে পারেন নাই ছত্তীসগঢ়ের সাংবাদিকেরা। আদিবাসীদের উপর পুলিশি নির্যাতনের খবর লিখিলেই ‘মাওবাদী’ বলিয়া পুলিশ ধরিবে, ইহা প্রায় নিয়ম দাঁড়াইয়াছে। সাংবাদিক সন্তোষ যাদব সতেরো মাস জেলবন্দি থাকিয়া মাস দুই আগে জামিন পাইয়াছেন। বাস্তার ছাড়িতে বাধ্য করা হইয়াছে সাংবাদিক মালিনী সুব্রহ্মণ্যমকে। অপর একটি অস্ত্র গণপ্রহার। সংসদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, ২০১৪-১৫ সালে ভারতে সাংবাদিকদের উপর আক্রমণের ১৪২টি ঘটনা ঘটিয়াছিল। এতগুলি ঘটনায় মাত্র বত্রিশ জন গ্রেফতার হইয়াছে। খোদ রাজধানীর পাতিয়ালা হাউসে শাসক-অনুগত আইনজীবীদের হাতে সাংবাদিকদের প্রহৃত হইবার দৃশ্য এ দেশ সহজে ভুলিবে না। সাংবাদিক খুনের ঘটনাও নিয়মিত ঘটিয়া চলিয়াছে। গত ষোলো মাসে অন্তত সাত জন সাংবাদিককে হত্যা করা হইয়াছে, আততায়ীরা অধিকাংশই অজ্ঞাত। বালি, পাথর, কয়লার অবৈধ কারবার হইতে রাজনৈতিক নেতা-আমলাদের দুর্নীতি, অনুসন্ধান করিতে গেলেই আক্রমণ নামিতেছে সাংবাদিকের উপর।
গোটা বিশ্বেই অসহিষ্ণুতা বাড়িয়াছে, কমিয়াছে সাংবাদিকের স্বাধীনতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন, দুটি দেশই স্বাধীন সাংবাদিকতার সূচকে পিছাইয়াছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ভাবে ক্রমাগত সংবাদমাধ্যমের প্রতি বিষোদ্গার করিতেছেন, তাহা গোটা বিশ্বে মুক্তচিন্তা ও গণতান্ত্রিক বিতর্কের পরিবেশ নষ্ট করিতেছে, বলিতেছে ওই আন্তর্জাতিক রিপোর্ট। সত্যের অনুসন্ধান, তথ্যের প্রকাশ অতি কঠিন হইতেছে। এ ক্ষতি শুধু সাংবাদিকের নহে। গত পাঁচ বৎসরে বাংলাদেশে অন্তত দশ জন ব্লগ-লেখক মর্মান্তিক ভাবে খুন হইয়াছেন। কয়েক সপ্তাহ পূর্বে পাকিস্তানে সাংবাদিকতার ছাত্র মশাল খানের মৃত্যু হইয়াছে গণপ্রহারে। তাঁহার নামে ঈশ্বরদ্রোহিতার অভিযোগ উঠিয়াছে। মলদ্বীপে নিজের বাড়িতে খুন হইয়াছেন তরুণ ব্লগ-লেখক, মুক্তচিন্তার সমর্থক ইয়ামিন রসিদ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে ধর্মে মৌলবাদ এবং রাজনীতিতে বিতর্কহীন আদর্শ-আনুগত্য যত প্রবল হইতেছে, চিন্তার স্বাতন্ত্র্য এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ততই বিপন্ন হইতেছে। আশঙ্কার আঁধার নামিতেছে, আনন্দসংগীত স্তব্ধ হইয়াছে, সঙ্গীহীন সত্যসন্ধানের যাত্রার এই শুরু।