আশির দশক হইতেই গণমাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণের বার্তা প্রচার করিয়াছে ভারত সরকার। ২০১৭ সালে সেই সরকারই ঘোষণা করিল, তাহা প্রদর্শিত হইবে কেবল গভীর রাত্রে। ইহাতে পরিবার পরিকল্পনা ক্ষতিগ্রস্ত হইবে কি না, যৌনরোগ বাড়িবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠিয়াছে। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রচারের বিষয়বস্তু সম্পর্কে একতরফা নিষেধাজ্ঞা কী করিয়া সরকার জারি করিতে পারে, সেই প্রশ্নটি কেহ করে নাই। হয়তো সকলেই ধরিয়া লইয়াছে, নরেন্দ্র মোদীর সরকারের নিকট এই ঔদ্ধত্যই প্রত্যাশিত। ধর্ম অথবা দেশপ্রেম, ঐতিহ্য অথবা শালীনতা, কোনও একটি আহত হইবার কারণ দর্শাইয়া বাক্স্বাধীনতা রুখিতে তৎপর হিন্দুত্ববাদীরা। তাহাদের অস্ত্র সেন্সর বোর্ডের লাল পতাকা, সোশ্যাল মিডিয়াতে ট্রোলিং, সরকারি নিষেধাজ্ঞা, অবশেষে গণপ্রহার। জানুয়ারিতেই সেন্সর বোর্ডে আটক হইয়াছিল ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’ ছবিটি। বৎসর শেষের মুখে বাধা পাইল ‘পদ্মাবতী’। ছবির নাম বদল করিয়া মুক্তি পাইয়াছে ‘সেক্সি দুর্গা’ ছবিটি, আদালত হইতে ছাড়পত্র আদায় করিয়া মরাঠি ছবি ‘ন্যুড’ প্রদর্শিত হইয়াছে জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে। ঝাড়খণ্ডে বিজেপি সরকার ইংরাজি ছোট গল্পের একটি সংকলন নিষিদ্ধ করিয়াছিল, পরে পিছু হটিয়াছে। এমনকী ভালবাসিবার স্বাধীনতাও আর নাই। ২০১৭ সালের ভারত ‘লাভ জিহাদ’ বলিয়া এক কল্পিত, অপ্রমাণিত আশঙ্কাকে সত্য বলিয়া গ্রহণ করিয়া তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছে।
প্রেমের স্বাধীনতা নাই, সৃষ্টি করিবার স্বাতন্ত্র্য নাই, সত্য বলিবারও উপায় নাই। বেঙ্গালুরুতে নিজের বাড়িতে গুলিতে প্রাণ হারাইলেন বাম ভাবাদর্শে পরিচালিত এক পত্রিকার সম্পাদক গৌরী লঙ্কেশ। সাংবাদিকের নামে মিথ্যা মামলা, অপপ্রচার, তাহার প্রাণনাশের হুমকি— নানা ভাবে চাপ সৃষ্টি করা হইতেছে। যাহারা সোশ্যাল মিডিয়াতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ভীতিপ্রদর্শন করিতেছে, এমনকী খুন করিবার হুমকি দিয়াছে, তাহাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ না করিবার সরকারি অবস্থানটিও সাংবাদিকদের আরও বিপন্ন করিতেছে। এক সুপরিচিত সাংবাদিক সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি লিখিয়া জানিতে চাহিয়াছেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে যে ব্যক্তিদের সহিত প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক রহিয়াছে, তাহারা যদি নিয়মিত প্রাণনাশের হুমকি দেয়, তবে সাংবাদিকের জীবন কি সুরক্ষিত? বাক্স্বাধীনতা খর্ব করিতে যাহারা সর্বদাই তৎপর, তাহারাই যে বেলাগাম হিংসা-বাক্যের পৃষ্ঠপোষক, এ বৎসর সেই সত্যটি ফের উপলব্ধি করিল ভারত।
আশ্বাসের কথা ইহাই যে, স্বাধীনতা বস্তুটির স্বভাব জল বা হাওয়ার ন্যায়। প্রাচীরে বাধা পাইলে আরও দুর্নিবার হইয়া ওঠে। বাক্স্বাধীনতার বিরোধিতার নানা ঘটনায়, বিশেষত গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যুতে, প্রবল জনরোষের সম্মুখে পিছু হটিতে হইয়াছে হিন্দুত্ববাদীদের। বরং বাক্সংযমের দাবি উঠিয়াছে বিপরীত দিক হইতে। নারীবিরোধী সংলাপে রাশ টানিবার দাবি উঠিয়াছে অন্তত দুইবার। সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতীয় একটি ছবিতে বিখ্যাত চিত্রতারকা মাম্মুটির নারী-অবমাননাকারী সংলাপের প্রতিবাদ করিয়াছেন অভিনেত্রী পার্বতী। তাহার ফলে তিনি হেনস্তা হইয়াছেন, কিন্তু পিছু হটেন নাই। অপর ঘটনাটি উত্তরপ্রদেশের। সমাজবাদী পার্টির প্রাক্তন মন্ত্রী আজম খান এক মহিলা ও তাঁহার কিশোরী কন্যাকে ধর্ষণের পরে তাঁহাদের সম্পর্কে কুরুচিকর বাক্য বলায় প্রশ্ন উঠিয়াছিল, বাক্স্বাধীনতার অধিকারের উপর মর্যাদাহানি না করিবার শর্ত আরোপ করা উচিত কি না। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখেও উঠিয়াছে। বাক্স্বাধীনতা আজ নাগরিকের মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সমরভূমি হইয়া উঠিয়াছে। নাগরিক সমাজ সহজে পিছু হটিবে, ২০১৭ তেমন ইঙ্গিত দেয় নাই।