লখনউ-এর দিকে এখন দেশের সমস্ত দৃষ্টি। গত কয়েক দিন উত্তরপ্রদেশে যাহা ঘটিল, সাম্প্রতিক কাশ্মীরও তাহার সহিত পাল্লা দিতে পারিবে কি না সন্দেহ। প্রতিবাদ সামলাইবার নামে সেই রাজ্যের একটি বিশেষ অংশের উপর নামিয়া আসিল চূড়ান্ত রাষ্ট্রিক নির্যাতন। দুর্ভাগ্যজনক বলিলেও কিছুই বলা হয় না। গণতান্ত্রিক দেশের জাতীয় ইতিহাসের লজ্জা উত্তরপ্রদেশের এই পর্ব। একটি চরম বৈষম্যমূলক কেন্দ্রীয় আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মোকাবিলা করিতে গিয়া সেখানকার পুলিশ নিঃশঙ্ক নির্দয় দমন-নিপীড়ন-অত্যাচারে নামিল। প্রতিটি প্রতিবাদকারীর চেহারা দেখিয়া ‘বদলা’ লওয়া হইবে বলিয়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কদর্য ভাষায় ও ভঙ্গিতে হুমকি দিলেন। সে ভঙ্গির বর্ণনা করিবার উপযুক্ত একটিই শব্দ: গুন্ডামি। বাস্তবিক প্রশাসন ও গুন্ডামির মধ্যে যে বিস্তর দূরত্ব, যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন তাহা শিখে নাই। সুতরাং বদলার অপেক্ষাও ভয়ঙ্করতর হইয়া উঠিল তাহাদের কার্যক্রম— বিভিন্ন মুসলিম এলাকার মায়েরা কাঁদিয়া জানাইলেন যে তাঁহাদের মহল্লা হইতে তেমন গোলযোগ না হইলেও তাঁহাদের নাবালক ছেলেমেয়েদের মারাত্মক প্রহার ও নির্যাতন করা হইতেছে। নাগরিক প্রতিবাদের নেতানেত্রীদের প্রতিবাদ করিবার দোষে গ্রেফতার করা হইল। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ-মিছিলের পিছন দিক হইতে তাড়া করিয়া মারিতে ছুটিতেছে পুলিশ, এমন ছবি ভাইরাল হইল। কাঁদানে গ্যাস হইতে পুলিশের গুলি কিছুই বাকি থাকিল না। বিশ জন নিহত হইলেন, যাঁহাদের অধিকাংশই অতিতরুণ। খবর আসিল, প্রতিবাদ-অশান্তিতে অংশগ্রহণকারীদের বাড়িঘর যাহা কিছু স্থাবর সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া সম্ভব, সরকারের তরফে তাহা নিলামে চড়াইয়া বিক্রি করিয়া দিবার ব্যবস্থা হইতেছে।
ইহারই নাম ফ্যাসিবাদ। ভারত একটি বৃহৎ রাষ্ট্র, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯-এর মতো একটি আপত্তিকর, অসাংবিধানিক, বৈষম্যভিত্তিক একটি আইন পাশ করিলে যে দেশের সর্বত্র নাগরিক সমাজ তাহা মুখ বুজিয়া মানিয়া লইবে, ইহা ভাবাই বাতুলতা ছিল। দেশের অনেকাংশেই বিক্ষোভ প্রতিবাদ ছড়াইয়া পড়িবে, প্রত্যাশিত থাকিবার কথা ছিল। কোথাও কোথাও প্রতিবাদ শান্তির পথ ছাড়াইয়া অশান্তি ও হিংসার দিকেও ছুটিতে পারে, তাহাও অভাবিত থাকিবার কথা নহে। প্রশাসনের তাহার জন্য তৈরি থাকা উচিত ছিল। অথচ দেখা গেল, কোনও প্রস্তুতি বা ভাবনাচিন্তার দরকার পড়িল না, নাগরিকের উপর দমন চালাইলেই তাহাদের মুখ বন্ধ করা যাইবে, এই ছাপ্পান্ন ইঞ্চির আক্রমণাত্মক পথই বিজেপি শাসিত অঞ্চলগুলিতে গৃহীত হইল। এই পথের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পথিক— উত্তরপ্রদেশ সরকার। কিন্তু এখানেই শেষ নহে। যে অতিরিক্ত প্রবণতা এই আদ্যন্ত ফ্যাসিস্ত কর্মকাণ্ডকেও ছাপাইয়া গেল— তাহার নাম সাম্প্রদায়িকতা। গত কয়েক দিনে উত্তরপ্রদেশ সরকারের সাম্প্রদায়িক মুখ প্রকাশ্য ও প্রকট। প্রকট প্রশাসনের জাতিবিদ্বেষ ও জাতিনির্যাতনের ভয়াবহ পরিকল্পনা।
নির্বাচিত বসতি-অঞ্চলে এই ভাবে আক্রমণ চালাইবার পরিকল্পনার পিছনে দুইটি লক্ষ্য সম্ভব, এক, ভয় দেখাইয়া মুখ বন্ধ করা, এবং দুই, পাল্টা হিংসার পথ তৈরি করিয়া পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করা। প্রশাসনকে কেন ও কখন এই দ্বিতীয় লক্ষ্যে প্রণোদিত হইয়া কাজ করিতে হয়, বলিবার প্রয়োজন নাই। নাগরিক শুভবোধ দিয়া এমন সুপরিকল্পিত ও সুপরিচালিত প্রশাসনিক হিংসার মোকাবিলার কাজটি সহজ নহে। কিন্তু যে হেতু কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে প্রতিকারের আশা স্বল্প, তাই শেষ পর্যন্ত নাগরিক প্রতিবাদের উপরই ভরসা রাখা ভিন্ন গতি নাই। গোটা দেশ উত্তরপ্রদেশের জন্য শঙ্কিত। আশা রহিল, কোনও না কোনও পথে দ্রুত এই শঙ্কার নিরসন ঘটিবে।