ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
ভারতবর্ষের ইতিহাসে গাঁধীজির আবির্ভাব যে ছিল একটা যুগান্তকারী ঘটনা, তা এ দেশের শিশুরাও জানে। কিন্তু, মুশকিলটাও কতকটা লুকিয়ে আছে সেখানেই। শিশু বয়সে রীতিমতো ঘাড়ে ধরেই এ সব শেখানো হয়। শৈশবে মুখস্ত করানো, আরও নানা চিরন্তন সত্য বা আপ্তবাক্যের মতো, বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে, সহজে তা ভুলেও যায় প্রায় সকলেই। অস্বাভাবিক বা অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার এটা একেবারেই নয়। আদতে, এটাই জগতের নিয়ম। এমনভাবে শেখানো তথ্য তেমন টেকসই হয় না কোনও দিনই। যাদের স্মৃতিশক্তি স্বাভাবিকের চাইতে যৎকিঞ্চিত বেশি, তারাই শেখানো বুলি বা তথ্য খানিকটা ধরে রাখতে পারে। সমাজে তারা অবশ্য সংখ্যালঘু। উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিভাবান হিসেবেও আমাদের সমাজে তারাই এত কাল কদর পেয়ে এসেছে। হাল আমলে, প্রযুক্তিসৃজিত কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তি অবশ্য এমন সব স্মৃতিধর, শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিতদের মৌরসিপাট্টাতেও আঘাত হানা শুরু করেছে। ফলে উঠছে শোরগোল।
কিন্তু, ভুললে চলবে না, জগতে আসল বুদ্ধি আর নকল বুদ্ধির তফাত এখনও ঘুচে যায়নি মোটেই। যাই বলুন আর তাই বলুন, খাঁটি আর মেকির তফাত ধরতে পারাটাই কিন্তু অকৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তির কাজ। সেই দক্ষতা, প্রতিনিয়ত প্রয়োগ ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে। ফলে তা অর্জন করা যায়। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ছিলেন বস্তুনিষ্ঠ, সামাজিক ও অর্জিত মানবপ্রতিভার এক অনন্য উদাহরণ। ইংরেজ শাসকেরা ১৯৪৭-এ তাঁর আন্দোলনের জন্যই ভারত ছেড়েছিল কি না, সে নিয়ে সংশয় থাকতেই পারে। কিন্তু, গাঁধীজি যে বিশ্বইতিহাসে আরও বিরাট একটা যুগান্তরের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশ রেখে গেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে আজকের পরিবেশ সঙ্কটে ও পরিবেশ আন্দোলনে।
শৈশব থেকে যৌবনে পৌঁছনো পর্যন্ত অবশ্য তেমন প্রতিভাবান ও বুদ্ধিমান বলে মোহনদাসকে কারও মনে হয়নি। আর পাঁচজনের সঙ্গে তফাতটা সর্বজনের চোখে ধরা পরেছিল ধীরে ধীরে। আসলে, তা গড়েও উঠেছিল একটু একটু করেই। আগেই বলেছি, সেই প্রক্রিয়াটি ছিল— প্রয়োগ ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, ছোট ও বড় সব রকম সত্য-বাস্তবতা-আদর্শকে যাচাই করে নেওয়ার প্রবণতা। সাধারণ ভাবে যা বিজ্ঞান এবং নৈতিকতা দুয়েরই মূল ভিত্তি।
অনুগামীদের সঙ্গে গাাঁধী।
‘সত্য নিয়ে আমার পরীক্ষানিরীক্ষা’— আত্মজীবনীর এই শিরোনামেই গাঁধী যে কোনও মানুষের গাঁধীসম হয়ে ওঠার সূত্র বা ফর্মুলাটিও সযতনে রেখে গিয়েছেন। আবার এটাও ঠিক যে— রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের নানা টানটান মুহূর্তে যুক্তির আশ্রয় না নিয়ে, ‘অন্তরের-বার্তা’ ও আরও নানা প্রত্যয়ের কথাও গাঁধী আখছার উল্লেখ করতেন, ব্যবহার করতেন। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তা নিয়ে উঠত তীব্র বিতর্ক। গাঁধীজি প্রসঙ্গে আলোচনায় সেই বিতর্কগুলি নিয়ে আমরা এখনও বড় বেশি চর্চা করি। ফলে, গাঁধীর মূল আদর্শ যে ছিল প্রয়োগ ও পরীক্ষাভিত্তিক বিজ্ঞানমনস্ক প্রকৃতি-প্রত্যয়, তা অনেকটা আড়ালে চলে গিয়েছে। কিন্তু, গাঁধীর সেই প্রকৃতি-প্রত্যয় বুঝে নেওয়া, আজ আমাদের এই বাস্তুগ্রহব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে, অন্তত এই দৃষ্টিকোণ থেকে গাঁধীকে জানার। রাজনৈতিক গাঁধী, দার্শনিক গাঁধী, শিক্ষাবিদ গাঁধী, এঁদের জানবার বোঝবার প্রয়োজন তো আছেই। কিন্তু, তাঁদের যেন অনেকাংশে ছাপিয়ে উঠছে প্রকৃতিবাদী গাঁধীজির ভূমিকা। কেন না, গাঁধীজির ১৯০৯ সালে লেখা ম্যানিফেস্টো হিন্দ-স্বরাজে উল্লিখিত ‘শয়তানের সভ্যতা’র অর্থ আজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি। অসময়ে নেমে আসা জলবায়ু পরিবর্তন-সহ প্রকৃতির নানা প্রত্যাঘাতে শুরু হয়ে গিয়েছে বিপথগামী সেই ‘সভ্যতা’র সার্বিক অস্তিত্বের সঙ্কট। হন্যে হয়ে আজ খুঁজতে হচ্ছে এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ। এবং প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন গাঁধীজি।
আরও পড়ুন: মোহনদাসের আপনভোলা হাসি শুনি, পঢ়ো, লিখো, কাম করো
আরও পড়ুন:গাঁধী কেবল এক ব্যক্তি নন, তিনি একটি নতুন প্রতিরোধের ‘ধারণা’
শিল্প, বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও পুঁজিকেন্দ্রিক আধুনিকতার সুবর্ণযুগে, আধুনিকতার মোহমুগ্ধ উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে, গাঁধীর প্রতিবাদী স্বরকে বিজ্ঞানমনস্কতা হিসেবে বোঝা একেবারেই সহজ ছিল না। জহুরিরা যদিও তা ইচ্ছে করলে চিনতে পারতেন। যেমনটা চিনেছিলেন আইনস্টাইন। নির্দ্বিধায় তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন: ভবিষ্যতের মানুষ বিশ্বাসই করবে না যে এমন একজন মানুষ একদিন এই পৃথিবীতে পা রেখেছিলেন। শুধু কি অহিংসার কথা মনে রেখেই এমনটা বলেছিলেন আইনস্টাইন? না কি বলেছিলেন আরও গভীর কোনও বোধ থেকে,সাক্ষ্য থেকে?
মনে রাখতে হবে, মানবপ্রকৃতি ও বিশ্বপ্রকৃতি দুটোকেই রক্ষা করার প্রনোদনা থেকে গাঁধীজি— যে আধুনিকতা বিজ্ঞানকে নৈতিকতা থেকে দ্বিখন্ডিত করে কার্যত অসামাজিক ও প্রকৃতিনাশক করে তুলছে— তাকে চিহ্নিত করছিলেন বারংবার। এমনকি, খ্রিস্টধর্মাবলম্বী সাম্রাজ্যবাদীদের বিশেষ ভাবে খোঁচা দেওয়ার জন্যেই, মানবতা রহিত বিজ্ঞানকে স্থান দিয়েছিলেন মানুষের সপ্তপাপ (Seven Sin) এর মধ্যে। আর, বিজ্ঞান ও নৈতিকতার মধ্যে এমনই এক প্রয়োজনীয় সেতু তৈরিতে বিজ্ঞানীদের জগতে সক্রিয় ভুমিকা নিয়েছিলেন আইনস্টাইন। হয়ে উঠেছিলেন গাঁধীজির মতই আর এক ব্যতিক্রমী স্বর। আজ প্রায় একশো বছর পরে, বিজ্ঞানের সঙ্গে নৈতিকতাকে যুক্ত করার সেই অবহেলিত, অথচ একান্ত অপরিহার্য কাজ কিন্তু অগ্রাধিকার পাচ্ছে দুনিয়ার সর্বত্র।
প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের বোধ সেই সময়ে ছিল আজকের থেকে অনেকটাই আলাদা। প্রথমত, বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভেও মানুষ নিজেকে মনে করত অন্যান্য জীবের থেকে স্বতন্ত্র। মনে করত, সে যেন স্বর্গচ্যুত বা শাপভ্রষ্ট দেবতার মত। ডারউইনের তত্ত্ব যাঁরা স্বীকার করতেন, তাঁরাও মানুষকে আধুনিক যুগের এই বিশেষ ক্ষমতার বেদি থেকে তখন ঠেলে ফেলেননি। আধুনিক যুগ ছিল মানবকেন্দ্রিক। গাঁধীজি প্রকৃতির মধ্যে মানবকেন্দ্রিকতাকে, মানব-আধিপত্যের এই একচেটিয়া অধিকারকে তেমন মান্যতা দেননি। দ্বিতীয়ত, তখনও বিশ্বপ্রকৃতিকে মনে করা হতো অসীম। ধরে নেওয়া হতো— জল, মাটি, বায়ুর সৃজনিশক্তি অফুরন্ত। প্রকৃতির আবহাওয়া-জলবায়ু মানুষ যে বদলে দিতে পারে, বদলে দিচ্ছে, তা ছিল চিন্তার অতীত। এই খানেও গাঁধী প্রশ্ন তুলেছিলেন মানুষের ইচ্ছা বিশেষত লোভ মেটাবার ক্ষেত্রে প্রকৃতির ক্ষমতা নিয়ে। এখন, বিজ্ঞানের দিক থেকে প্রকৃতি বিষয়ে উপরোক্ত দুটি প্রচলিত ধারনাই প্রায় পরিত্যক্ত হওয়ার পথে।
যমুনালাল বাজাজের সঙ্গে মহাত্মা গাঁধী।
জৈববৈচিত্র ও বাস্তুতন্ত্রের বোধ এখন প্রকৃতি বিজ্ঞানের কেন্দ্রে চলে এসেছে। প্রকৃতির অংশ জীবজগত্, আর সেই জীবজগতের একটি শাখা আমরা। জীবজগতে কেউ কারও ঊর্ধ্বে, কারও নিম্নে অবস্থান করে এমন নয়। আমরা ধরাধামে অন্যান্য অনেক জীবের তুলনায় অর্বাচীন বা নবাগত এক প্রজাতি। প্রকৃতি থেকে জন্ম, প্রকৃতির মধ্যে বাস, মৃত্যুর পরেও যেটুকু বস্তু নিয়ে আমাদের দেহ তৈরি, তা প্রকৃতিতেই থেকে যায়। প্রকৃতির মধ্যে রয়েছে শৃঙ্খলাচক্র ও ভারসাম্য রক্ষার শক্তি ও নীতি। প্রকৃতিকে ধংস করে বা ক্ষতিগ্রস্ত করে মানুষ কেন, কোনও জীবই যে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না, তা ঠেকে শিখছি আমরা। অথচ, আধুনিক বিজ্ঞান প্রকৃতিকে দাস বানাতে চেয়েছিল, মানুষকে প্রভু। প্রগতি ও উন্নয়নের নাম করে প্রকৃতি ও সমস্ত জীবজগতের ঊর্ধ্বে নিজেকে অক্লেশে স্থাপনা করেছিল। ফলে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের মধ্যে বিচ্ছেদ, শত্রুতা ও অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে। সেই প্রবণতা এখনও সম্পূর্ণ দূর হয়নি। যাঁরা প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভালবাসা ও রক্ষা করার কথা বলেন– তাঁরাও অনেকেই এখনও প্রচলিত উন্নয়নের প্রয়োজনকে প্রশ্ন করতে রীতিমতো অরাজি। প্রশ্ন হল— যে আধুনিকতা ও উন্নয়নের পথে চলতে গিয়ে আমরা সর্বনাশা প্রাকৃতিক দূষণ ও বিপর্যয় ডেকে এনেছি, সেই পথে আরও এগোতে থাকলে কি আমরা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাব? খুব কম মানুষ এত দিন এই ব্যাপারটা বুঝতে চাইতেন। মানুষের লোভের উপর রাশ টানা, সরল প্রয়োজন ও আকর্ষক অতিরিক্তের মধ্যে প্রভেদ বুঝতে শেখানো হয়নি আমাদের। ফলে আমরা উত্তরোত্তর অতৃপ্তি বাড়িয়ে চলেছি, নতুন নতুন অতৃপ্তি নির্মাণ করছি, যা মেটাবার ক্ষমতা প্রকৃত ও বাস্তুতন্ত্রের নেই। এমনকি প্রযুক্তি দিয়েও এ থেকে উদ্ধার মিলবে না।
বিপদ এখানেই যে, প্রয়োজন মেটানোর চাইতে নতুন নতুন চাহিদা ও তার বাজার তৈরি করাই এখন হয়ে উঠছে প্রযুক্তির প্রধান কাজ। আর তারই অনুষঙ্গে সভ্যতার বিনাশ প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠছে। যা থেকে মুক্তির জন্যে চাই, business as usua। বা প্রচলিত পন্থার সঙ্গে সম্মিলিত অসহযোগ। চাই, অর্থনীতির অভিমুখ বদলে ফেলা। নিরন্তর বৃদ্ধি নয়, একদিকে বস্তুগত প্রয়োজনকে সীমার মধ্যে বেঁধে ফেলা, অন্যদিকে জীবনকে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী নিয়মের সঙ্গে নতুন করে মিলিয়ে নেওয়া। যার উদাহরণ ভারতীয় সমাজ সভ্যতায় ছিল। ছিল বলেই, ভারতীয় সভ্যতা সুস্থায়ী হতে পেরেছিল।
নিজের যাপনচিত্রে এই প্রকৃতিবান্ধবতা স্বচ্ছভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন গাঁধীজি। জানতেন, আধুনিক সভ্যতার ব্যাধি নিরসনের জন্যে দীর্ঘপথ হাঁটতে হবে আমাদের। সেই দুরের যাত্রাই ছিল সম্পূর্ণ বিপ্লবের যাত্রাপথ। প্রকৃতির ভারসাম্যে ফিরে যাবার পথ। যে কেউ একটু মনোযোগ সহকারে দেখলেই তার চোখে ধরা পড়বে যে— গাঁধীজির শিক্ষা ভাবনা, সুস্বাস্থ্যের ভাবনা, সম্প্রীতির ভাবনা, নৈতিকতার ভাবনা— সবই ছিল একান্ত মানব-কেন্দ্রিক নয়, সার্বিকভাবে প্রকৃতি কেন্দ্রিক।
ভরসার কথা এটাই— সমাজনিষ্ঠ, অভিজ্ঞতাঋদ্ধ এমন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অকৃত্রিম বুদ্ধি থেকে বিচ্ছুরিত হয় যে আন্তরিক আলো, সর্বসাধারণ তা দেখতে পান। সেটাই ছিল গাঁধীজির জনমোহিনী শক্তির প্রকৃতি। আজকের ভারতীয় রাজনীতির ও বিশ্বরাজনীতির জনমোহিনী প্রকৃতির তা সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। বিংশ শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ-দাঙ্গা-দুর্ভিক্ষ লাঞ্ছিত কলুষিত বিশ্ব, প্রাণের প্রদীপ নিয়ে আসা যে অল্প কজন সাধক প্রেমিক ও পাগলকে পেয়েছিল, গাঁধীজি তাঁদেরই একজন। ভারতবর্ষের গ্রামীণ মানুষ ও প্রান্তিক মানুষদের তিনি ভরসা জুগিয়েছিলেন। পরাধীন দেশে হয়ে উঠেছিলেন এক প্রবল ইতিবাচক শক্তি।
বর্তমান যুগসন্ধিতে পৌঁছে তাঁর কথা এখন আমাদের কাছে অনেক বেশি সুবোধ্য, ব্যবহারিক, ও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। গাঁধীজির যে সব কথা পাগলের প্রলাপ বলে একদা নিন্দিত হয়েছিল, তাদের সত্যমূল্য একটু একটু করে বুঝতে পারছি আমরা। এটা সম্ভব হতো না, প্রকৃতিবোধের অনির্বাণ আলোকশিখা থেকে, যদি না, প্রাণের প্রদীপটি জ্বালিয়ে নিতেন এই অনন্য সত্যসাধক।
সমস্ত ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে নেওয়া।