জাতীয় বিপর্যয় বা অতিবিরল ঝড়, যে নামেই ডাকা হোক না কেন, মানুষের বিপন্নতার হেরফের ঘটে না। নামকরণে অর্থবরাদ্দ বাড়তে পারে। ধরে নেওয়া যাক, প্রথা ভেঙে, সেই টাকা যথেষ্টই দেওয়া হল এবং তার ষোলো আনাই বিপর্যয়-পরবর্তী পুনর্গঠনের কাজে লাগানো হল। তা হলেও কি ভুক্তভোগী জীবনের ক্ষতগুলো মুছে ফেলা যাবে? সেই ক্ষত তো শুধু ঝড়ের হুঙ্কার ও মুহুর্মুহু উপড়ে পড়ার মধ্যে কোনওক্রমে জীবন রক্ষার আতঙ্কই নয়, তার চেয়ে অনেক গভীর। খেত-পুকুর-ঘর-গাছ-গরু-ছাগল— সর্বস্ব গেছে। হাতের জোরে, ক্রমে কেউ কেউ সে সব আবার গড়ে তুলবে, যেমন বিধ্বংসী আয়লার পর করেছিল। কিন্তু, যে হাতের জোরে মানুষ ‘মানুষ’, তাকে সেই হাত পেতে রাখতে হচ্ছে ‘ত্রাণ’ হিসেবে দেওয়া খাবারের অপেক্ষায়। যে হাত ফসল ফলায়, জলের গভীর থেকে খুঁজে তোলে মাছ, নৌকা ভাসিয়ে রাখে তুফানের জলে, মানুষের অতুল গৌরব সেই হাতকে ‘ত্রাণ’ সংগ্রহের যে লাঞ্ছনা সইতে হল, সারা জন্মে সেই দুঃস্মৃতি থেকে সে পরিত্রাণ পাবে?
স্বাভাবিক প্রতিপ্রশ্ন, প্রকৃতির ওপর তো কারও হাত নেই। সে যদি এমন বিরূপ হয় তা হলে মানুষ কী করবে? আগে তো প্রাণটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তার পর মান-অপমান, মর্যাদা-অমর্যাদার প্রশ্ন। আপত্তিটা এখানেই। পশ্চিমবঙ্গের একটা বিশেষ এলাকা, সমুদ্র-উপকূল ও সন্নিহিত ভূভাগে প্রকৃতি বারংবার রুষ্ট হয়, এটা অজানা নয়। আবার দিনে দিনে প্রকৃতির বিরূপতা বিষয়ে আগাম খবরের মানও অনেক উন্নত হয়েছে। পূর্বাভাসের ভিত্তিতেই মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে এনে প্রাণহানি আটকানোর মতো ব্যবস্থাও করা গেছে। কিন্তু ঝড়ের প্রলয়ঙ্কর হয়ে ওঠার যে ঘোষণা ছিল, সে তুলনায় প্রস্তুতি ছিল নামমাত্র। দুর্গত বহু এলাকায় লোকেদের সামনে খাবার ও পানীয় জলের অসহনীয় সঙ্কট। অনেক জায়গায় মানুষের এই ঘোর বিপদে সহনাগরিকরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সর্ব ক্ষেত্রে তেমন সাহায্য পৌঁছে উঠতে পারেনি। সে সব অঞ্চলে মানুষের জীবন যে কতটা দুর্বিষহ তা অনুমান করতেও ভয় হয়।
সহনাগরিকদের উদ্যোগগুলো আশা জাগায়। ঝড়ের পর দিন থেকেই অজস্র মানুষ বিপন্নদের সাহায্যার্থে নানা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। যখন নাকি প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের পীড়িত মানুষদের সাহায্যের জন্য এক হাজার কোটি টাকার নিষ্ঠুর ব্যঙ্গে নিজেই মাতোয়ারা, তখন অসংখ্য সাধারণ মানুষ অকাতরে অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য নিয়ে হাজির হচ্ছেন। নানা জায়গায় বিপন্নতার পাশাপাশি একটা অন্য ছবি— মানুষের পাশে মানুষ। কিন্তু, যতই দৃষ্টিনন্দন হোক, যতই আশার বাণী শোনাক, এ দৃশ্যগুলো কোনও স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। সাধারণ মানুষের উদ্যোগ স্বতঃস্ফূর্ত, ব্যক্তিগত বা বড় জোর কিছু সামাজিক যোগাযোগের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা। সেই কারণে কুলতলি, হিঙ্গলগঞ্জ, পাথরপ্রতিমার বহু জায়গায় সাহায্যের হাত যেমন পৌঁছেছে, তেমনি অনেক জায়গাই সাহায্য-বিচ্ছিন্ন হয়ে সামাজিক দ্বীপভূমি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এখানেই সরকারের ভূমিকা। প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারার মতো ব্যবস্থা সরকারই করতে পারে। দুর্বিপাকের ঠিক পরে পরেই সর্বত্র ‘ত্রাণ’ নিয়ে হাজির হওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু যে কোনও রকম সঙ্কট হলে তার মোকাবিলার জন্য স্থানীয় মানুষের যোগদানে একটা পূর্বপ্রস্তুতির ব্যবস্থা গড়ে তোলা খুবই সম্ভব। যেমন, জনপদ ঘিরে একটি করে মজবুত সুরক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলা— নতুন বাড়ি বানানোর দরকার সব জায়গায় নেই, স্কুল বা অন্যান্য সরকারি পরিকাঠামোতেই সেগুলো করা যেতে পারে, যেটা জরুরি তা হল, আর্থিক ক্ষমতা সহ সেগুলোর পরিচালনার ভার স্থানীয় মানুষদের হাতেই তুলে দিতে হবে। দুর্বিপাকের পূর্বাভাস পাওয়া মাত্রই তাঁরা সেগুলোতে খাবার, পানীয় জল, ওষুধ, প্রভৃতি সামগ্রী মজুত করে ফেলতে পারবেন। বিপদ ঘটে যাওয়ার পর কবে কেউ ত্রাণ নিয়ে আসবে তার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকার অপমান থেকে লোকেরা নিজেরাই নিজেদের মুক্তি দিতে পারেন। স্থানীয় সমুদয়ের হাতে এই ক্ষমতা ন্যস্ত করার একটা প্রধান কারণ, বিশেষ অঞ্চলের বিশেষ প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় তাঁদের বংশ পরম্পরায় অর্জিত জ্ঞানকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো।
সুন্দরবন অঞ্চলে বহু জায়গাতেই বার বার বলা সত্ত্বেও নাকি নদীবাঁধগুলো সারাই করা হয়নি। সেটা করা থাকলে অনেক জনপদকে জলমগ্ন হওয়া থেকে বাঁচানো যেত। যার অর্থ, সেখানকার জমিগুলোকে লোনা জলে ডুবে গিয়ে দীর্ঘ দিন নিষ্ফলা হওয়া থেকে বাঁচানো যেত, মাছ বাঁচানো যেত, এবং আরও অনেক কিছু রক্ষা করা সম্ভব হত। কিন্তু, যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, বাঁধ মেরামতে, সরকারি কর্তৃপক্ষ খুব একটা গা তো করেনি বটেই, এমনকি এই অভিযোগও আসছে যে অনেক জায়গায় ক্ষমতাবান গোষ্ঠীরা নিজেদের ইটভাটার জন্য অবাধে নদীবাঁধের মাটি কেটে নিয়ে গেছে। এ অত্যন্ত জটিল সমস্যা। এই লুটেরা গোষ্ঠীগুলো একই সঙ্গে আর্থিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, এবং দুর্বৃত্তিগত ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু মানুষের কাছে যদি এক বার বার্তা যায় যে সরকার এদের দমন করতে আগ্রহী, তা হলে সে কাজটা করে ওঠা খুব কঠিন নয়।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলায় স্থানীয় মানুষের এই ভূমিকা বিশ্বস্তরে গুরুত্ব পেয়েছে। ২০০৫ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অন ডিজ়াস্টার রিডাকশন-এর একটি উদ্দেশ্যই ছিল ‘সমস্ত স্তরে, বিশেষত স্থানীয় স্তরে বিপর্যয় মোকাবেলার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ও ক্ষমতা গড়ে তোলা’। সাম্প্রতিক কালে করা তুরস্ক, জাপান, জামাইকা, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, তাইল্যান্ড, প্রভৃতি দেশে করা গবেষণা দেখাচ্ছে, বিপর্যয় মোকাবিলায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সরকারি অর্থবরাদ্দ যতখানি জরুরি, ততখানি জরুরি হচ্ছে স্থানীয় মানুষের যোগদান। এই যোগদানের গুরুত্ব নিয়ে নানা অভিমতের মধ্যে একটাই সূত্র: ‘‘বিশেষজ্ঞরা অনেক কিছু জানেন, কিন্তু আমাদের অঞ্চলটাকে আমরাই ভাল জানি।’’ স্থানীয় মানুষের যোগদানে সাফল্যের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে তাঁদের হাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং আর্থিক ক্ষমতা নিশ্চিত করা।
কিন্তু, সমস্যা হল, স্থানীয় মানুষের সার্থক যোগদান কী ভাবে ঘটবে? বিশ্ব জুড়েই বিপর্যয় মোকাবিলার ব্যাপারে স্থানীয় মানুষের যোগদানের প্রশ্নটিতে নানা সমস্যা: ওপরের সঙ্গে নীচের যথাযথ সংযোগ সাধনের, কিংবা সাধারণ আমলাতন্ত্রের, অথবা একেবারে চিরায়ত, বিকৃত ক্ষমতা-সম্পর্কের। কিংবা স্থানীয়দের মধ্যে থেকেই স্থানীয় লোকেদের ঠকানোর জন্য ‘প্রতিনিধি’ উঠে আসার সমস্যা। মানুষের বিপন্নতায় মানুষের হাত বাড়িয়ে দেওয়াটা যেমন সত্য হতে দেখছি, তেমনই এটাও নিকষ সত্য যে, কলকাতা মহানগরেই বিপর্যস্ত মানুষকে নিষ্পেষিত করে কিছু ‘স্থানীয়’ লোকে টাকা রোজগার, মদ-মাংস পর্যন্ত সব কিছু করে যাচ্ছে, কুণ্ঠার লেশমাত্র নেই। এই আমপানের পরেই ত্রাণের কাজে যাওয়া বেশ কয়েক জনের দুর্ভাগ্যপূর্ণ অভিজ্ঞতার অভিযোগ শুনে হাড় হিম হয়ে আসে। এ কোন সভ্যতায় আমাদের বাস! স্থানে স্থানে পঞ্চায়েত কর্তারা, বা বিশেষ বিশেষ দলের ক্ষমতাধররা ত্রাণের কাজে সরাসরি বাধা দিচ্ছেন। ক্ষমতার বলে এঁরাই স্থানীয় প্রতিনিধি, এঁদের যোগদানে কোনও উদ্যোগ কতটা সফল হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এমনকি পুলিশ সঙ্গে নিয়ে ত্রাণ বিলি করতে যেতে হয়েছে বলেও শোনা গেল।
পৃথিবী জুড়ে স্থানীয় মানুষের ক্ষমতা ও ক্ষমতাহরণের দ্বন্দ্ব চলছে, তার মধ্যে সাফল্য ও ব্যর্থতার নানা কাহিনি। এ দেশেও সাফল্যের উদাহরণ বিরল নয়। কেরল রাজ্য তো বারংবার নানা বিপর্যয় মোকাবিলায় এই উদ্যোগ দেখিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গও কি করেনি? ১৯৭৮ সালের বন্যা মোকাবিলায় স্থানীয় মানুষের সক্ষমতার ব্যবহার আমরা অনেকেই দেখেছি। সেই উদ্ভাবনের উৎস ছিল স্থানীয় মানুষকে উদ্যোক্তার ভূমিকায় দেখতে চাওয়ার রাজনৈতিক স্বচ্ছদৃষ্টি। ক্ষমতার সংক্রমণে তা কতটা ঘোলাটে হয়ে উঠল তা তো দেখেছি আমরা, দেখেছি পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন ভাবে জিতবার কুৎসিত বাসনা। স্থানীয় মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠানই হয়ে উঠেছিল শোষণের হাতিয়ার।
তার মানে এই নয় যে, পঞ্চায়েত ব্যবস্থাটাকেই ফেলে দিতে হবে। সে চেষ্টাও চলছে, আমলাতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। অথচ এই ব্যবস্থাই একদা মানুষের প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল কেরলে। তাই, ভাবা দরকার, কী করে স্থানীয় মানুষদের যোগদানের মধ্য দিয়ে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকেও দূষণমুক্ত করা যায়। কী করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে মানুষের কাছে জবাবদার করে তোলা যায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলার কাজটা স্বতন্ত্র কোনও কর্তব্য নয়, মানুষের ওপর মানুষের আক্রমণ প্রতিরোধের সঙ্গে তার যোগ অবিচ্ছেদ্য। বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিরন্তর আঘাত সইতে না পেরে প্রকৃতি প্রত্যাঘাত করছে। সেই নিয়মটা কিন্তু মানবসমাজেও খাটে।