হায় কলম! তোমার দিন গিয়াছে। সাংবাদিকের কলম, এক কালে তরোয়ালের চেয়েও পরাক্রান্ত বলে যার খ্যাতি ছিল। প্রখর বাক্যবাণ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আশায় অসিধারী সৈন্যদের উপরেও নির্ভর করতেন রথী-মহারথীরা। লাভ তবু হত না। ফরাসি বিপ্লবের মন্ত্রণাদাতা হিসেবে দায়ী করা হয় রুসো, ভলতেয়ার, মঁতেস্কু-র কলমকে। ইহুদি আলফ্রেড ড্রেফুসে-র প্রতি অবিচার করা হয়েছে বলে একাই ফরাসি সরকারকে প্রায় টলিয়ে দিয়েছিলেন এমিল জ়োলা। ভারতের স্বাধীনতা বন্দুকের জোরে আসেনি, এসেছিল গাঁধী-সহ বহু চিন্তাবিদের কথা ও লেখার জোরে। মাও জে দং-এর রেড বুক নানা দেশে বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করেছে। ভিক্তর উগো এক বার লিখেছিলেন, যে সব চিন্তাভাবনা কালের স্রোতে এসেছে, বিশ্বের বৃহত্তম সেনাবাহিনীরও তা ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা নেই।
সাংবাদিকদের ভূমিকা এত জরুরি ছিল, কারণ গণতন্ত্রের একটি মূল উপাদান সংবাদ। যদি সকলের অভিমত নিয়ে সরকার চালাতে হয়, তা হলে সেই সব মত তথ্যনির্ভর হওয়া দরকার। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে খবরের কাগজ চালু হওয়ার পর অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে অধিকাংশ দেশে, বিশেষত বড় বড় শহরে তার জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়ে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকেই আবার সংবাদপত্রের সংখ্যা কমে আসছে। একুশ শতক নিয়ে এসেছে নতুন সব চ্যালেঞ্জ। সাংবাদিকেরা ক্রমশ ব্যবসায়িক ও অন্য জনসংযোগের কাজে যুক্ত হচ্ছেন।
সংবাদপত্রের প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল যে, তার নাম টেলিভিশন। রেডিয়োতে খবর শুনলেও সকালে কাগজ পড়ার অভ্যেস সকলেরই ছিল। কিন্তু বাড়িতে টিভি ঢুকে যাওয়ার পরে সকাল-বিকেল যখন খুশি খবর পাওয়া যায়। ব্যস্ত মানুষ কাগজ কেনার খরচটুকু বাদ দিতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম, ইন্টারনেট। নিখরচায় কিছু পাওয়া গেলে কে আর বাড়তি পয়সা গুনতে চায়? খবরে যাঁদের আগ্রহ আছে এবং উদ্বৃত্ত পয়সা আছে, তাঁরাই কেবল কাগজের নিয়মিত গ্রাহক হলেন। যে কোনও খবরের কাগজই এখন ইন্টারনেটে পড়া যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিনামূল্যে। এবং দিনের যে কোনও সময়ে। এর ফলে প্রায় সব দেশেই সংবাদপত্রের সংখ্যা কমছে, সাংবাদিকদের রুজি-রোজগার বিপন্ন হচ্ছে। এক কালে সংবাদ প্রতিষ্ঠানের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বেসরকারি বিজ্ঞাপন ও সরকারি বিজ্ঞপ্তি। এখন সে সবও হাজির টিভি-ইন্টারনেটে। এক কালে সংবাদপত্রের ব্যবসাকে ‘সুবর্ণস্রোত’ আখ্যা দেওয়া মিডিয়া-সম্রাট রুপার্ট মার্ডকের অভিমত, সেই স্রোত দ্রুত ক্ষীয়মাণ। যে সব দেশে কম্পিউটার ও স্মার্টফোনের ব্যবহার এখনও কিছুটা কম, সেখানে খবর কাগজের অবস্থা অপেক্ষাকৃত সবল।
সংবাদপত্রের এই যে নিম্নগামী জনপ্রিয়তা, তার ফল ভয়াবহ। যে সব কাগজ এত দিন মোটামুটি নির্ভয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করত, তারা হঠাৎ নিজেদের দুর্বলতা বুঝে গিয়ে অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত। অর্থনৈতিক ভিত টলে যাওয়ায় তারা পুঁজিপতিদের সহজ শিকার। গত কয়েক দশকে প্রচুর খবরের কাগজ বিলুপ্ত হয়েছে, মালিকানা চলে গিয়েছে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাতে। বিজ্ঞাপন প্রত্যাহারের ভয় খবরের কাগজের স্বাধীনতা খর্ব করছে।
সঙ্গে সঙ্গেই এসেছে আর একটি গভীর সমস্যা— সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা। এখন আর সংবাদের উৎস দু’টি-একটি নয়, প্রভূত। টিভির সংবাদ যত জনপ্রিয় হয়েছে, জোগানদারের সংখ্যাও বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সেই সব খবর সরবরাহের পিছনে নানা অন্যায় স্বার্থ কাজ করে। এখন সাধারণ মানুষও তা বোঝেন। আর তার ফলে সাংবাদিকদের সম্পর্কে বিশ্বাসে ভাঙন ধরেছে। তাঁরা অনেক সময় ঠিক খবরকেও ভুয়ো মনে করে অগ্রাহ্য করেন।
সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন দেশের সুবিধাবাদী ক্ষমতালোভী সরকার। গত দু’বছরে দুষ্কৃতী দমনের নামে প্রায় ছ’হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ফিলিপিন্সে, অথচ সরকারি হিসেবে সংখ্যাটা মাত্র শ’তিনেক। সে দেশের কাগজগুলিরও অন্য কথা বলার উপায় নেই। সত্যি কথা ফাঁস করে দেওয়ার জন্য জেলে পাঠানোর চেষ্টা চলছে বিখ্যাত ফিলিপিনো-আমেরিকান সাংবাদিক মারিয়া রেসা-কে। প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানের আমলে তুরস্কেও প্রায় সব কাগজেই একই সুরে খবর লেখা হয়, অন্যথায় ‘শাস্তি’র আশঙ্কা। রাশিয়া বা চিনে তো ভিন্ন মতের কোনও পরিসরই নেই। প্রেসিডেন্টের অপছন্দের কিছু ছাপার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। ‘গণতান্ত্রিক’ দেশেও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা অপরিচিত নয়। স্বাধীন সাংবাদিকতার স্বর্গরাজ্য আমেরিকাতেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে সাংবাদিকদের হেনস্থা হতে হয়েছে। ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা মায়ানমারে সরকারবিরোধী খবর লেখা সহজ কাজ নয়। রোহিঙ্গা-নির্যাতনের কথা লিখে দু’বছর ধরে মায়ানমারের জেলে আটকে রয়েছেন রয়টার্স-এর দুই সাংবাদিক। ইদানীং পিছিয়ে নেই ভারতও। সরকারি নীতির বিরোধিতা করা আর বিজ্ঞাপন আসা বা না আসা কি সম্পর্কযুক্ত? প্রশ্ন উঠছে এ দেশেও।
নির্ভীক ও তথ্যসমৃদ্ধ সংবাদ পরিবেশন ছাড়া নাগরিকদের পক্ষে কী ভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সম্ভব? তাই হয়তো রাষ্ট্রশক্তি গণতন্ত্রের এই স্তম্ভকে ক্রমশ কোণঠাসা করে ফেলছে। হায় সাংবাদিক! তোমার দিন গিয়াছে।