সম্পাদকীয়১
CAA

বিরাট দুঃসাহসেরা

সহজ না হইলেও উত্তর খুঁজিবার কাজটি করিতেই হইবে। কেননা, বর্তমান মুহূর্তের ভারতীয় ছাত্রআন্দোলনই বলিয়া দিতেছে যে, ছাত্ররাজনীতির মধ্যে স্তরভেদ এবং প্রকারভেদ করা অত্যন্ত জরুরি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৩৬
Share:

নরেন্দ্র মোদী সরকারকে যে দেশব্যাপী ছাত্রআন্দোলন যথেষ্ট বিপাকে ফেলিতেছে, তাহা এখন স্পষ্ট। স্বাভাবিক ভাবেই, পাল্টা প্রশ্ন উঠিতেছে, ছাত্রআন্দোলনের ন্যায্যতা লইয়া। ছাত্রদের জন্য ‘অধ্যয়নং তপঃ’ মন্ত্রই কি প্রথম ও শেষ কথা হওয়া উচিত নহে? কেন তাহারা রাজনৈতিক কার্যক্রমে জড়াইয়া পড়িতেছে? ইত্যাদি। প্রশ্নগুলি, এক অর্থে, অতিসরল। রাষ্ট্রনীতির হিসাবে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা ঠিক বিদ্যালয়গামী বালকবালিকা নহে, তাহারা বয়ঃপ্রাপ্ত নাগরিক, তাহাদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অবকাশ থাকিবারই কথা। এবং ইতিহাসের হিসাবে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত ও সচেতন ছাত্রেরাই যে ক্ষমতার মুখে প্রশ্ন ছুড়িয়া দিতে ছুটিয়া আসে, বহু দেশে বহু বার দেখা গিয়াছে। অন্য এক অর্থে অবশ্য, প্রশ্নগুলির এক গভীরতর তাৎপর্য আছে। ছাত্ররাজনীতির ফলে বিদ্যালাভের পরিবেশ অনেকাংশে সঙ্কুচিত হয়, পাঠজীবন ব্যাহত হয়, তাহা উড়াইয়া দেওয়া যায় না। ভারতের জাতীয় আন্দোলনের সময়ও নেতাদের মধ্যে দ্বিমত ছিল, ঠিক একশত বৎসর আগের মহাত্মা গাঁধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের কথা ভাবিলেই তাহা মনে পড়িবে। কেহ চাহিয়াছিলেন, ছাত্রেরাই যেন আন্দোলনের পুরোভাগে থাকে। কেহ বলিয়াছিলেন, সে ক্ষেত্রে ছাত্রদের প্রথম ও প্রধান কাজটি ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়িয়া ছাত্রেরা পথে বাহির হইয়া আসিলে একটি উচ্চতর তলে ক্ষমতার সহিত সংঘর্ষের প্রস্তুতিকেও হয়তো তাহারা হারাইবে। ছাত্রেরা বয়ঃপ্রাপ্ত ঠিকই, কিন্তু তাহাদের তো আরও অনেক দূর দায়িত্ববান হিসাবেই বিকশিত হইবার কথা। আন্দোলনে অংশগ্রহণই কি তাহাতে সাহায্য করে? না কি, প্লাবনে না ভাসিয়া নিজ কর্মপথে স্থিত থাকিলেই আত্মবিকাশ ও জাতিবিকাশ নিশ্চিত হয়? উত্তর সহজ নহে।

Advertisement

সহজ না হইলেও উত্তর খুঁজিবার কাজটি করিতেই হইবে। কেননা, বর্তমান মুহূর্তের ভারতীয় ছাত্রআন্দোলনই বলিয়া দিতেছে যে, ছাত্ররাজনীতির মধ্যে স্তরভেদ এবং প্রকারভেদ করা অত্যন্ত জরুরি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের যে কোনও রকম আন্দোলন বা রাজনীতিকে এক দাগে দাগাইয়া দেওয়া— অত্যন্ত অনৈতিক ও মূর্খামি। যখন দলীয় রাজনীতির শাখা হিসাবে কলেজে কলেজে ছাত্ররাজনীতি উত্তাল হইয়া উঠে, তখন তাহার যে রূপ ও প্রকার, আর যখন শাসকের বৈষম্যনীতি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছাত্রেরা নাগরিক অধিকারের দাবিতে গর্জিয়া উঠে, তাহার যে ব্যঞ্জনা— এই দুইকে আলাদা করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ স্পষ্ট, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অধিকারের দাবি কলেজ ইউনিয়নটিকে নিজেদের দখলের রাখিবার লক্ষ্যে উচ্চারিত হইতেছে না, নিষ্পেষিত জনসমাজকে রক্ষা করিবার শপথ হিসাবে উদ্‌যাপিত হইতেছে। এই শপথের মধ্যে আত্মত্যাগের ভাবনা আছে, ন্যায্যতর সমাজ প্রতিষ্ঠার কল্পনা আছে: যাহা তরুণ প্রজন্মেরই বিশিষ্ট সম্পদ। ছাত্র বলিয়া তরুণসমাজকে সেই ভাবনা, কল্পনা ও কর্মব্রত হইতে টানিয়া পিছনে ধরিয়া রাখা যায় না। ঠিক এই কারণেই, দেশে দেশে কঠিন নির্যাতনের আশঙ্কার মুখে ছাত্রসমাজ বাহির হইয়া আসে দ্বিধাহীন ভাবে। দলীয় রাজনীতির হিসাবনিকাশের ধার না ধারিয়া, নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির দুর্ভাবনাকে পাত্তা না দিয়া। ভুলিলে চলিবে না, ক্ষুদিরাম বসু হইতে ভগৎ সিংহ পর্যন্ত তারুণ্যের এই বিরাট দুঃসাহসই ভারতকে এক দিন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আনিয়া দিতে পারিয়াছিল। নেতারা কত দূর সফল হইতেন, যদি না জনতার সম্মুখসারিতে থাকিত সেই ছাত্রেরা, যাহারা জানিত রক্তদানের পুণ্য, যাহারা পারিত স্পর্ধায় মাথা তুলিবার ঝুঁকি লইতে। সব রাজনীতি সমান নহে। গণতান্ত্রিক দেশের যুবসমাজকে সম্মান করিতে হইলে দেশের বা জাতির সঙ্কটমুহূর্তে ছাত্ররাজনীতির মূল্য স্বীকার না করিয়া উপায় নাই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement