ছবি: সংগৃহীত
অর্থনীতির গাড়িটা যে ঠিকঠাক চলছে না, সে কথা অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন তাঁর বাজেট বক্তৃতায় এক বারের জন্যও স্বীকার করলেন না। ইকনমিক সার্ভে বা অর্থনৈতিক সমীক্ষা মানল যে আর্থিক বৃদ্ধির গতিভঙ্গ হয়েছে। তবে, সমীক্ষার মতে এর কারণ দেশের অভ্যন্তরে চাহিদার অভাব নয়, আন্তর্জাতিক বাজারের ঝিমুনি।
জাতীয় আয় ঠিক রফতানির ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে নেট রফতানি, অর্থাৎ রফতানি থেকে আমদানি বাদ দিলে যে অঙ্কটা পাওয়া যায়, তার উপর। পঞ্চাশের দশক থেকেই ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশাল ঘাটতি, মানে আমদানির তুলনায় রফতানি অনেক কম। এই ঘাটতি কমলে জাতীয় আয় বাড়ার কথা। অর্থনৈতিক সমীক্ষার হিসেবে দেখতে পাচ্ছি, ২০১৮-র এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-এ ওই একই সময়ে এই ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ১১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটা শুভ লক্ষণ, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের সমস্যার কারণে আমাদের অর্থনীতি ঝিমোচ্ছে, এই হিসেব দিয়ে এই তত্ত্ব দাঁড় করানো যাচ্ছে না।
অর্থাৎ সমস্যাটা অভ্যন্তরীণ। এবং, জোগানের দিক থেকে নয়, চাহিদার দিক থেকে। সমস্যাটা জোগানের দিক থেকে হলে এত অবিক্রীত পণ্য গুদামে পড়ে থাকত না। কাজেই, আগের প্রশ্নটাতেই ফিরে যাচ্ছি— দেশে চাহিদা বাড়ানোর জন্য এই বাজেট কী পদক্ষেপ গ্রহণ করল?
প্রথমেই নজর পড়ে আয়করের দিকে। পুরনো কর-কাঠামোর একটি বিকল্প কাঠামো অর্থমন্ত্রী পেশ করেছেন। পুরনোর তুলনায় নতুন কাঠামোতে বার্ষিক পনেরো লাখ টাকা আয় অবধি করের হার কম, কিন্তু পুরনো কাঠামোতে যে ছাড়গুলো ছিল নতুনে সেগুলি নেই। অর্থমন্ত্রী দাবি করছেন, নতুন নিয়মে কর দিলে মধ্যবিত্ত করদাতারা লাভবান হবেন। এর ফলে অবশ্য অর্থ মন্ত্রক বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব পাবে। আমরা কি ধরে নিতে পারি করদাতারা এই ৪০ হাজার কোটি টাকার সিংহভাগ জিনিসপত্র কেনার পিছনে খরচ করবেন?
কমবয়সি করদাতাদের অনেকেরই গৃহঋণ আছে। আগের কর-কাঠামোতে ঋণশোধের সুদের অংশের ওপর তাঁরা ছাড় পেতেন। এটা খুব কম নয়। আর যাঁরা বাড়ি কেনেননি তাঁরা বেশির ভাগই ভাড়া বাড়িতে থাকেন। নতুন কাঠামোতে বাড়িভাড়ার ওপরেও করছাড় পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া দেড় লাখ টাকা অবধি প্রভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদিতে জমানোর সুবিধেটাও ছাড়তে হচ্ছে। কাজেই প্রশ্ন উঠছে, নতুন প্রজন্মের করদাতাদের কাছে নতুন কাঠামোটা আকর্ষক হবে তো? বয়স্কদের তুলনায় এঁরাই কিন্তু জিনিসপত্রের ওপর বেশি খরচ করেন।
বয়স্ক করদাতাদের নিয়েও একটা সমস্যা আছে। নতুন কাঠামোতে কর দিলে হয়তো এঁদের কিছু লাভ হবে। কিন্তু যে হেতু এঁদের ভবিষ্যৎ চাকরির মেয়াদ অল্প, তাই তাঁরা ভবিষ্যতের জন্য বেশি সঞ্চয় করেন। ফলে হাতে আসা এই বাড়তি টাকাটার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তাঁরা হয়তো খরচ না করে জমিয়ে ফেলবেন। সব মিলিয়ে বিকল্প একটা কর-কাঠামো আনা সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত ভোগের ওপর খরচ কতটা বাড়াবে, তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে।
এ বার গ্রামের মানুষের হাতে সরাসরি সরকারি টাকা পৌঁছে যাওয়ার কথায় আসি। গরিবের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়ার দুটো বড় প্রকল্প আছে— আগের আমলের একশো দিনের কাজের প্রকল্প, সংক্ষেপে যার নাম মনরেগা, আর বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী কৃষি সম্মান নিধি। প্রথমটাতে গ্রামের গরিব মানুষ কায়িক পরিশ্রমের কাজ করে টাকা পান, দ্বিতীয়টাতে সরকারের কাছ থেকে গরিব কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি ঢুকে যায় বছরে ছ’হাজার টাকা, এর জন্য কিছু করতে হয় না।
মনরেগার বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় ১৩% কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কৃষি সম্মান নিধির বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ৩৭%। আগের বছর মনরেগা ও কৃষি সম্মান নিধি মিলিয়ে মোট বাজেট বরাদ্দ ছিল ১২৫৩৭২ কোটি টাকা। এ বছর দু’টি প্রকল্প মিলিয়ে বরাদ্দ হয়েছে ১৩৬৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দু’টি প্রকল্প মিলিয়ে বরাদ্দ বেড়েছে ৮.৮%। কিন্তু, এই মুহূর্তে দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.৩৫%। কাজেই এই ভর্তুকির প্রকৃত বৃদ্ধি মাত্র ১.৪৫%। তার উপর স্মরণ করা যেতে পারে, গ্রামের গরিব মানুষ সবার আগে তাঁদের খাদ্যের প্রয়োজন মেটাবার চেষ্টা করেন এবং খাদ্যদ্রব্যে মূল্যবৃদ্ধির হার আরও অনেক বেশি। তা হলে, শিল্পদ্রব্য কেনার মতো কতটুকু বাড়তি টাকা তাঁদের হাতে থাকছে?
আসলে, চাহিদার অভাব মেটানোর চেষ্টা অর্থমন্ত্রী করেননি, তাই চাহিদা বাড়ানোর দাওয়াই এই বাজেটে তেমন ভাবে দেখতে পাওয়া যাবে না। বিকল্প কর-কাঠামো প্রস্তাব করা হয়েছে কর দেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে আরও সহজ করার জন্য, জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়াবার জন্য নয়। একই ভাবে কৃষি সম্মান নিধির বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে কৃষকদের কল্যাণের কথা মাথায় রেখে। কিন্তু এর ফলে দেশে উৎপাদিত জিনিসপত্রের চাহিদা কতটা বাড়বে, সে হিসেবটা করা হয়নি। অতি-দক্ষিণপন্থী জোগান-ভিত্তিক অর্থনীতির একটা ধারণা অর্থমন্ত্রীকে চালিত করেছে।
এই ধারণার সবটাই মূল্যহীন, তা নয়। জোগান-ভিত্তিক অর্থনীতি দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কথা ভেবে উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলিকে আরও দক্ষ হতে বলবে। বাজেটে গ্রাম সড়ক যোজনায় ৩৭% বরাদ্দ বেড়েছে, স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে বরাদ্দ বেড়েছে ২৭%, সেচ-সহ কৃষি পরিকাঠামো উন্নতিতে বেড়েছে ১৩.৩%। এই বরাদ্দ বৃদ্ধি যে দেশের দীর্ঘমেয়াদি বিকাশের জন্য, বিশেষ করে গ্রামের গরিব মানুষের উন্নতির জন্য দরকার, তাতে সন্দেহ নেই।
একটা ব্যাপারে কিন্তু গভীর সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। দক্ষ পরিকাঠামো নির্মাণের দুই স্তম্ভ, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য, দু’টি ক্ষেত্র থেকেই সরকার ধীরে ধীরে হাত গুটিয়ে ফেলতে চাইছে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা থেকে। ধরে নেওয়া হচ্ছে, এই দু’টি ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগকারীরা এসে সরকারের অভাব মিটিয়ে দেবে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। প্রস্তাব করা হচ্ছে, জেলায় জেলায় হাসপাতাল তৈরি হবে বেসরকারি উদ্যোগপতির সঙ্গে সরকারি উদ্যোগের মেলবন্ধনে, পিপিপি মোডে। বোঝা দরকার, বেসরকারি উদ্যোগপতিরা লাভের সম্ভাবনা দেখলে তবেই বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন। কিন্তু শিক্ষা বা স্বাস্থ্যক্ষেত্র থেকে লাভ করতে গেলে পরিষেবার দাম বাড়াতে হবে। তখন সেই পরিষেবা সাধারণ গরিব মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। এটা অনৈতিক তো বটেই, কিন্তু তার থেকেও বড় কথা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা গরিব মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেলে এই মানুষগুলোর মধ্যে যে দক্ষতা ও প্রতিভা সুপ্ত আছে তা সমাজের কাজে লাগবে না।
এটা একটা বড় সামাজিক ক্ষতি। শিক্ষা বা স্বাস্থ্য পরিষেবা যিনি পাচ্ছেন, তিনি ছাড়াও এই পরিষেবা থেকে গোটা সমাজটা উপকৃত হচ্ছে, কারণ এর ফলে দেশে একটা শিক্ষিত ও স্বাস্থ্যবান শ্রমিকশ্রেণি তৈরি হচ্ছে। এই সামাজিক উপকারটা কোনও বেসরকারি উদ্যোগপতির হিসেবে থাকবে না। তাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবায় সরকারের পূর্ণ উপস্থিতি প্রয়োজন। অর্থমন্ত্রী কথাগুলো বিস্মৃত হয়েছেন।
আর একটা প্রশ্ন। আমাদের গরিব দেশে এত দিন এলআইসি সাধারণ মানুষকে যে সামাজিক নিরাপত্তা দিয়ে এসেছে, বেসরকারি কোনও সংস্থা এলআইসি-কে কিনে নিলে সেটা পাওয়া যাবে কি?
অর্থনীতি বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা