২৪ জুন, ১৯৫৩। সেদিন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছিল, ‘গভীর শোকের অন্তর্দাহে মূহ্যমান লক্ষ লক্ষ নরনারীর দীর্ঘ ব্যাকুল প্রতীক্ষান্তে মঙ্গলবার রাত্রি ৮-৫৫ মিনিটে ভারতের তেজোদৃপ্ত নেতৃত্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিগ্রহ ডা: শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মরদেহ একখানি বিশেষ বিমানযোগে দমদম বিমানঘাটিতে উপনীত হইলে বিপুল জনারণ্যে এক মর্মস্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয়। বিদ্রোহী বাঙ্গলার ঐতিহ্যবাহক প্রাণাপেক্ষা প্রিয়তর নেতার জন্মভূমি হইতে বহুদূরে কাশ্মীরে নির্বাসনকালে মৃত্যু হইয়াছে এই দুঃসহ অনুভূতি বিমানঘাটিতে উপস্থিত জনসমুদ্রকে অধিকতর বিচলিত করিয়া তোলে।’
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে ঘিরে বাঙালির এই আবেগ এত দিন ইতিহাসের পাতাতেই ছিল। তা খুঁজে-পেতে তুলে আনার সূত্রপাত গত বছরের অগস্টে। কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের সময়। তৃণমূল কংগ্রেস যখন সংসদে এর বিরোধিতা করছে, তখন নরেন্দ্র মোদী সরকারের মন্ত্রীরা যুক্তি দিয়েছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ কাশ্মীরের ৩৭০ রদের জন্য নিজের জীবনের ‘বলি’ দিয়েছিলেন। তৃণমূল ৩৭০ রদের বিরোধিতা করে তাঁর অপমান করছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের আর এক বছরও দেরি নেই। মঙ্গলবার অমিত শাহর বাংলার জন্য ভার্চুয়াল জনসভা থেকেই বিজেপির প্রচারের ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে। এবং গোড়া থেকেই নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ শ্যামাপ্রসাদকে ঘিরে শিক্ষিত, ভদ্রলোক বাঙালি, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বাঙালি হিন্দুদের আবেগ নতুন করে জাগিয়ে তুলতে চাইছেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই কলকাতা বন্দরের নামকরণ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে করার ঘোষণা করেছিলেন। কলকাতায় দাঁড়িয়েই। রাজা-বাদশাই হোক বা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জিতে আসা রাজনৈতিক দল— যে কোনও শাসক শ্রেণিই তার ঐতিহ্যের স্মারক রেখে যেতে চায়। ক্ষমতায় এসে স্মৃতিতে দাগ রেখে যাওয়ার এই ইচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। তাই কারও মূর্তি তৈরি হয়, কারও নাম লেখা হয় রাস্তার সাইনবোর্ডে, বিমানবন্দরে। স্বাধীন ভারতে এত দিন বিজেপি এই সুযোগ বিশেষ পায়নি। তাই মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মুঘলসরাইয়ের নাম বদলে দীনদয়াল উপাধ্যায় করে দেওয়ার তাড়না দেখা দিয়েছে।
কলকাতা বন্দরের সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদের নাম জুড়ে দেওয়ার পিছনে অবশ্য ঐতিহ্যের স্মারক রেখে যাওয়ার তাগিদই একমাত্র কারণ নয়। আগে বোঝা দরকার, কেন শ্যামাপ্রসাদ?
ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালি। উচ্চশিক্ষিত। মেধাবী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যর আশুতোষের পুত্র। স্নাতকে ইংরেজি অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস। আইনে পারদর্শী। সব থেকে কম বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। আসলে বাঙালি যেমন নায়ক চায়, শ্যামাপ্রসাদ ঠিক তেমনই ছিলেন। কলকাতায় শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরের পরিস্থিতির বর্ণনায় আনন্দবাজারে লেখা হয়েছিল, ‘সঙ্গে সঙ্গে কলিকাতার সকল কাজ যেন স্তব্ধ হইয়া যায়। কাহাকেও বলিতে হয় নাই। যাহারা সারাদিনের প্রত্যাশায় সবে বিপণি সাজাইয়াছিল, তাহারা উহা বন্ধ করিয়া দেয় এবং যাহারা বিপণি খুলিতে যাইতেছিল, তাহারা উহা অবরুদ্ধ রাখিয়া ডাক্তার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির বাসভবনের দিকে যাত্রা করে।’
এটা যেমন বাস্তব, তেমনই বাস্তব হল, পশ্চিমবঙ্গে প্রথমে কংগ্রেস ও তার পরে বামফ্রন্টের জমানায় হিন্দু মহাসভার নেতা, জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদের ইতিহাস ক্রমশ পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে। শ্যামাপ্রসাদের জন্যই এ দেশে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামক রাজ্যটি রয়েছে, না হলে গোটা বাংলাই দেশভাগের সময় মহম্মদ আলি জিন্নার খপ্পরে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেত বলে বিজেপি নেতারা গলা ফাটিয়ে চললেও লাভ হয়নি।
দেশভাগের ইতিহাস বলে, জিন্না, সোহরাওয়ার্দি, ফজলুল হকের মতো মুসলিম নেতাদের সঙ্গে শরৎ বসুও চেয়েছিলেন বাংলাকে না ভেঙে অখণ্ড বাংলা থাকুক। ভারতবর্ষের সঙ্গে সেই বাংলার সম্পর্ক কী হবে, তা তখনও ছিল খানিক ধোঁয়াটে। এ দিকে কংগ্রেসের অধিকাংশ প্রধান নেতাই এই প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না, সাভারকরের হিন্দু মহাসভায় যোগ দেওয়া শ্যামাপ্রসাদও নন। শ্যামাপ্রসাদ লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে চিঠি লিখে বাংলা ভাগের প্রস্তাব দেন। কংগ্রেসে ও মহাসভার উদ্যোগে স্পর্শকাতর এলাকাগুলিতে গণভোট হয়। বাংলাকে হিন্দুপ্রধান ও মুসলিম-প্রধান, দু’ভাগে ভাগের প্রস্তাব তৈরি হয়।
ফলত এই শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে বিজেপির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। দেশভাগের ক্ষত স্মৃতি থেকে সহজে মুছে যায় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত মুসলিম তোষণের অভিযোগ খাড়া করা গেলে সেই ক্ষতে নুনের ছিটে পড়ে বইকি। ওপার বাংলা থেকে চলে আসা বাঙালি পরিবারের মনে এখনও তা বাড়তি ক্ষোভ তৈরি করে। অমিত শাহ ও তাঁর দলের নেতারা তা আরও উসকে দিতে বলেন, শ্যামাপ্রসাদ যে হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গের জনক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই মাটিতেই সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি করছেন।
পশ্চিমবঙ্গের বড় অংশের মানুষের কাছে বিজেপি দীর্ঘ দিন ‘হিন্দি বলয়ের দল’ হিসেবেই পরিচিত ছিল। বাংলায় বিজেপির রাজনৈতিক ভিত তৈরির পথে সেটা ছিল প্রধান বাধা। বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদের আবেগ রামমন্দির আন্দোলনের হাত ধরে হিন্দি বলয়ে দানা বেঁধেছিল বটে। কিন্তু বাংলায় তাতে লাভ হয়নি।
বিজেপি নেতৃত্ব এখন নতুন করে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে অরবিন্দ ঘোষের হাতে বাংলাতেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের সলতে পাকানো শুরু। এমনকি দেশকে ‘ভারতমাতা’ হিসেবে দেখার ভাবনার জন্মও বাংলার মাটিতে, অবন ঠাকুরের ছবির হাত ধরে। বিজেপি নেতারা বোঝানোর চেষ্টা করেন, বাঙালিরা বরাবরই বামপন্থী মনোভাবাপন্ন বলে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। ইতিহাসবিস্মৃত বাঙালিও তা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। কিন্তু ১৯৩০-এর আগে বাংলায় বামপন্থার এই প্রভাব ছিল না। অগ্নিযুগের বাঙালি বিপ্লবীরা কালী বা ভারতমাতার নামেই শপথ নিতেন।
মুশকিল হল, ইতিহাসে বর্তমানের রাজনীতিতে চিঁড়ে ভেজে না। আজ বাংলায় পায়ের তলায় জমি খুঁজে পেলেও কোনও বাঙালি বুদ্ধিজীবী আইকনকে এখনও বিজেপি নিজের ছাতার তলায় আনতে পারেনি। বিজেপি ক্ষমতায় এসে গেলে হয়তো অনেকেই শিবির পাল্টাবেন। কিন্তু এখনও ধর্মনিরপেক্ষ পরিচিতি বজায় রাখতে উদ্গ্রীব বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা বিজেপির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলছেন। শ্যামাপ্রসাদকে আঁকড়ে ধরা ছাড়া তাই বিজেপির কাছে উপায় নেই।
তবে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ বাঙালি মননের আর একটি দুর্বল জায়গা ছোঁয়ার চেষ্টা করছেন। পোড়খাওয়া দুই রাজনীতিক বিলক্ষণ জানেন, বাঙালি এখনও দেশের অন্য রাজ্যের মানুষের থেকে নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান, সংস্কৃতিবান, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভাবতে ভালবাসে। ‘আজ বাঙালি যা ভাবে, বাকি দেশ কাল তা ভাবে’ শুনলে বাঙালি এখনও আহ্লাদিত হয়। গুজরাতি অমিত শাহর মুখে ‘এই বাংলাই এক কালে গোটা দেশকে পথ দেখাত, সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় আন্দোলন, স্বাধীনতার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিত’ শুনলে বাঙালি এখনও আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই অমিত শাহরা মনে করিয়ে দেন, বঙ্কিমের বন্দেমাতরম্, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনগণমন-র বাংলায় এখন রাজনৈতিক হিংসার দাপটে গুলি-বোমার আওয়াজ শোনা যায় কেন?
বাম জমানার শেষ পর্বে পার্টির নিচু তলায় যে লুম্পেন শ্রেণির উত্থান হয়েছিল, তৃণমূলের জমানায় শীর্ষস্তরেই লুম্পেন-রমরমা। মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, হিন্দু বাঙালি এমনিতেই লুম্পেন শ্রেণির দাপটে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। আর, নালিশ করেন, মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যালঘু তোষণের কুফলে মুসলিম সমাজের একাংশ আইনের তোয়াক্কা করে না।
মোদী-শাহ সোনার বাংলার কথা বলে সেই শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, হিন্দু বাঙালিকে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখাতে চাইছে। কিন্তু তাঁদের কাছে এখনও বাংলায় তেমন কোনও মুখ নেই। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই ভরসা।