আদর্শের লড়াইটাই সব নয়
Politics

সরকারের উদ্ধত মনোভাবে নষ্ট হচ্ছে সংস্কারের ভাল উদ্দেশ্য

রাজনৈতিক আকচাআকচিতে পড়ে মাঝামাঝি দাঁড়ানোর জমিটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। খোয়া যাচ্ছে সমষ্টিগত বিচারশক্তি

Advertisement

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share:

রাজনৈতিক বিরোধিতার দুটো রূপ। একটা আদর্শভিত্তিক, অন্যটা বাস্তববোধভিত্তিক। এই সময়ে ভারতের রাজনীতির তরজার পুরোটা দাঁড়িয়ে গিয়েছে শুধুই আদর্শের সংঘাতে পরিণত হয়েছে। এক দিকে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদীর অন্ধ অনুরাগীরা। ইদানীং তাঁদের ‘ভক্ত’ পরিচিতিটি উপহাসের পর্যায়ে নেমে এসেছে। আর অন্য দিকে রয়েছেন বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা, বিভিন্ন রাজনীতির রঙে রাঙানো উগ্র সমালোচকরা, যাঁদের একমাত্র রাজনৈতিক ঐক্য কেবল মোদী-বিরোধিতার প্ল্যাটফর্ম। তাই, এক দল মানেন, মোদী কোনও ভুল করতে পারেন না। অন্য দল জানেন, মোদী যা করেন সব খারাপ, সব ভুল।

Advertisement

এই সব রাজনৈতিক আকচাআকচিতে পড়ে মাঝামাঝি দাঁড়ানোর জমিটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। খোয়া যাচ্ছে সমষ্টিগত বিচারশক্তি। আমাদের অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়নকে ঠান্ডা মাথায় নিরাসক্ত ভাবে জরিপ করার ক্ষমতাটাই চলে যাচ্ছে।

ফলে রাজনৈতিক বিভাজনরেখাটা ক্রমশ হচ্ছে বজ্রকঠিন। এর সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এখনই দরকার সংস্কার আর নতুন ভাবনা। দরকার বিগতকালের সমাজবাদ লালিত বস্তাপচা রীতিনীতি থেকে মুক্তি।

Advertisement

এখন, প্রধানমন্ত্রী মোদীর কার্যপদ্ধতি নিয়ে বিস্তর অভিযোগের কারণ থাকতে পারে। কিন্তু তিনি বেসরকারি সংস্থাগুলির পালে হাওয়া জোগাতে সচেষ্ট, এবং অতীত দশকের সব খাপছাড়া নীতির ফলে তাদের সামনে অগুনতি বাধাকে সরাতে প্রয়াসী— তাঁর এই চেষ্টাটাকে কিন্তু দুষলে মুশকিল।

কেননা, সমাজবাদী চিন ও রাশিয়া-সহ পৃথিবীর সব দেশই বহু দিন বুঝে নিয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি ভাবে অর্থনীতির মোড় ঘোরাতে হলে একমাত্র ভরসা বেসরকারি সংস্থা। একমাত্র তাদেরই আছে দেশের অর্থনীতির বৃদ্ধির স্রোতের কান্ডারি হওয়ার শক্তি।

অন্য দিকে, ভারতের রাজনৈতিক প্রভুরা ও তাঁদের মতাদর্শ এত দিন ধরে সমানেই বেসরকারি সংস্থার কাজকর্মকে পিছনে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছে। বুঝতে অসুবিধে নেই, শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত ভোটারদের তুষ্ট করার অভিপ্রায়েই এ সব করা।

আরও একটা কথা। রাজনৈতিক দলগুলি ব্যবসা ও শিল্পক্ষেত্রকে চাপে ফেলে টাকা আদায় করায় বিশ্বাস করে। সেটাই এই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অন্তরায় সৃষ্টির দ্বিতীয় কারণ। সবাই ভাল করে জানে, যতই কোনও নির্দিষ্ট নিয়মের বালাই থাকবে না, ততই চওড়া হবে টাকা আদায়ের সুযোগ ও রাস্তা। রাজনৈতিক সুবিধে, লাইন ভেঙে দেওয়া ঢালাও বদান্যতা, স্বজনপোষণ ঢালাও চালানো যাবে।

এই বিধিব্যবস্থায় ক্ষমতাবানরা থাকেন রাজার হালে। কিন্তু প্রকট হয় অর্থনীতির নিদারুণ অকর্মণ্যতা আর পরিব্যাপ্ত দুর্নীতি। এরই একটি উদাহরণ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, চিরকালই যা ক্ষতির বোঝা টানছে। তবু যে তা টিকে থেকেছে, তার কারণ নেতা-আমলারা এর মাধ্যমে মোটা টাকা লোটেন। ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত্রগুলি নিয়েও ফুলিয়েফাঁপিয়ে দেখানো বিশাল চুক্তির ভার একটা বড় চাপ হয়ে দাঁড়ায়।

এই অবস্থাটাকেই বদলাতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। অভূতপূর্ব দ্রুততায় সরকারি ক্ষেত্রগুলির বেসরকারিকরণ করেছেন, অনড় শ্রম আইনগুলিকে শিথিল করে দিয়েছেন। এত দিন যে সব ক্ষেত্র কর্পোরেটের জন্য রুদ্ধকপাট ছিল, যেমন প্রতিরক্ষা ও কৃষি— সেখানেও তাদের প্রবেশাধিকার মিলেছে। কর্পোরেট সংক্রান্ত আইন ও বিধিনিষেধগুলিকে সহজ করার, সরকারকে আর একটু ব্যবসায়ী-সহায়ক করে তোলার প্রয়াস জারি রয়েছে।

সম্প্রতি যে বিপুল বিতর্কিত কৃষি বিপণন সংক্রান্ত আইন পাশ হয়েছে, এইখানটিতেই তা জোর দিয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে কর্পোরেটের গুরুত্ব বাড়াতে চেয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের ভূমিকা কমিয়েছে, সুবিধাভোগীদের মৌরসিপাট্টায় কোপ বসিয়েছে।

হইচই শুরু হয়েছে— দেশকে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বেচে দেওয়া হচ্ছে! দুরাত্মা সরকার আমাদের নিষ্ঠুর পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। সমালোচকরা গলা ফাটিয়ে বলছেন, সরকারের পয়লা পছন্দ গুজরাতের টাকার গদিওয়ালারা।

প্রতিবাদটা হচ্ছে নৈতিকতার ভিত্তিতে। বড় ব্যবসায়ী মানেই মন্দ লোক— এই ধারণার বশবর্তী হয়ে। আদর্শের চাপে এই তথ্যটি চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে যে, আজ সারা পৃথিবীতেই তেজি কর্পোরেটই অর্থনীতির আসল রেসের ঘোড়া।

আমেরিকায় যেমন অর্থনীতি চালনার মূল ভারটা নিয়েছে শীর্ষস্থানীয় কিছু অতিকায় সংস্থা। অ্যামাজ়ন, গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাপল, বোয়িং, ইনটেল এবং অনুরূপ কিছু সংস্থার কারণেই আজ আমেরিকা সবাইকে ছাপিয়ে যেতে পেরেছে।

কমিউনিস্ট চিনের ছবিটাও পৃথক নয়। রাষ্ট্র সক্রিয় ভাবেই হুয়াওয়ে প্রভৃতি সংস্থার পৃষ্ঠপোষক। জাপানে ‘জ়াইবাৎশু’ (লগ্নিজোট) যেমন মিতসুবিশি, সুমিমোতো এবং অন্যদের তো সেই উনিশ শতক থেকেই শাসকের সহায়তা মিলছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে পরিবার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়িক মহাজোট। যেমন এলজি, হুন্ডাই, এসকে, লোটি এবং স্যামসাং। প্রত্যক্ষ রাষ্ট্রীয় মদতে তারাই অর্থনীতির প্রধান শক্তি।

পৃথিবীর কোথাওই তা হলে গল্পটা অন্য রকম নয়। ভাল লাগুক বা না-ই লাগুক, বিশ্বের আঙিনায় খেলতে হলে নিজের উচ্চতাটা বাড়িয়ে নিতেই হয়। পকেটের মাপটা বড় হওয়া চাই, চাই সাঙ্ঘাতিক কলজের জোর। অন্য দিকে, ভারতের কর্পোরেট ক্ষেত্র এখনও বৃদ্ধির পথে রয়েছে। তার ভিতর হতে জনা কয়েক মহাবলীর উঠে আসা প্রয়োজন। তাই অন্যান্য দেশের মতোই যদি এখানেও সরকার তৎপর হয়ে কিছু সৌভাগ্যবানকে উৎসাহ দেয়, তা হলে আকাশ ভেঙে পড়বে না।

বর্তমান সরকারের কাজকর্মের উদ্দেশ্য নিয়ে তাই অসুবিধে নেই। অসুবিধেটা হল, তারা সেটাকে যে ভাবে কাজে পরিণত করতে চাইছে, সেখানে। কর্পোরেট ক্ষেত্রের বিষয়টাই ধরা যাক। তাদের বৃদ্ধির পথ সুগম করতে উৎসাহ দিতে হবে, উদ্দীপনাও জোগাতে হবে। কিন্তু তাদের উপর প্রয়োজনীয় কার্যকর নিয়ন্ত্রকবিধি চালুও জরুরি, যাতে তারা কেবল নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পথেই না চলে।

পশ্চিমের দেশগুলোতে কোনও কর্পোরেট সংস্থাই সমীক্ষা-নিরীক্ষার ঊর্ধ্বে নয়। ব্যক্তিগত পরিসর, পরিবেশ, ন্যায়বিচার, গ্রাহকের অধিকার ইত্যাদিকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। এমনকি গুগল-কেও নিয়ন্ত্রণকর্তার কোপে পড়তে হয়।

অন্য দিকে ভারতে, জনতার অধিকার ও স্বার্থের প্রসঙ্গ উঠলে কিন্তু এই নিয়ন্ত্রকদের দেখায় অত্যন্ত দুর্বল আর গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশে বিচারব্যবস্থা এতই অক্ষম, নড়বড়ে যে ভারতকে মনে করা হয় পৃথিবীর কয়েকটি দেশের অন্যতম যেখানে চুক্তিনামা চালুই করা যায় না। এমনকি কর্পোরেট-চোরেরাও ব্যাঙ্কের, মানুষের সহস্র কোটি টাকা তছরুপ করে স্রেফ কেটে পড়তে পারে।

অতএব, বড় ব্যবসাদারদের সাহায্য করার নামে সরকার এখানে সাধারণ মানুষের হাতটাই ছেড়ে দিচ্ছে। জন-আবেগ এ ভাবে আহত হলে বিপদ হবে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্ধত কর্মপন্থাও আপত্তিকর। কৃষি সংক্রান্ত আইন তিনটির যথেষ্ট সদ্‌গুণ থাকলেও যে ভাবে সেগুলিকে পাশ করিয়ে নেওয়া হল, তারই অনিবার্য পরিণতি এই তীব্র প্রতিবাদ। তর্ক, আলোচনার প্রয়োজন এই ক্ষেত্রে অনেকটাই, বদলের প্রয়োজনও অনেক। কয়েকটি বিধান পড়ে তো মনে হচ্ছে কোনও দুষ্টমতি কর্পোরেট আইনজীবী সেগুলো লিখিয়ে নিয়েছেন। বলা হয়েছে, চাষি ও অন্য যাঁদের স্বার্থ জড়িত, তাঁরা কেউ এই আইনগুলি থেকে উদ্ভূত কোনও বিষয়ে আইনি সাহায্য নিতে পারবেন না। মৌলিক অধিকারকে এ ভাবে নস্যাৎ করার চেষ্টা করলে বিক্ষোভের আগুন তো জ্বলবেই।

শস্য মজুতে অবাধ অনুমতির চেষ্টা, এবং চাষিকে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নাকচের চেষ্টাও সমান আপত্তিজনক। গরিব এই দেশে অর্থনীতি সব সময় খাদের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। বড় মাপের পালাবদল সর্বসম্মতিক্রমেই আসা উচিত। সোজাসুজি ফরমান জারি করে দেওয়া যায় না।

কোভিড-১৯ অতিমারি এই দেশকে অর্থনৈতিক অন্ধকূপে ঠেলে দিয়েছে। সেখান থেকে বেরোতে চাইলে আইনের হাত ধরে, সংস্কারের তাজা হাওয়া বুকে টেনে উঠে দাঁড়াতে হবে। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সরকারের দুর্বিনীত আচরণ তাদেরই পোঁতা বীজগুলোই না শুকিয়ে মরে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement